শিবব্রত রায়।
বছর পাঁচেক আগে শেষ বার কলকাতায় আসেন। স্বাধীনতা দিবসের দুপুরে, সোমবার জার্মানির হামবুর্গে ফোন ক্যামেরার সামনে স্পষ্ট গোটা গোটা বাক্যে দেশের কথা বললেন তিনি।
৯৮ ছুঁই ছুঁই শিবব্রত রায় বলছিলেন, “দেশের লোকের ভাল করা অনেকটা সম্ভব হয়েছে। ভারতবর্ষ স্বাধীন। নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। আরও উন্নতি হয়তো সম্ভব হয়নি…!” হামবুর্গবাসী কৃতী ইঞ্জিনিয়ারের আবার রজনীকান্ত সেনের নাতি (রজনীকন্যা শান্তিলতার পুত্র)। রজনীকান্তের আর এক দৌহিত্র, শিবব্রতের অগ্রজ দিলীপকুমার রায়ও যৌবনে স্বদেশি রাজনীতিতে জড়ান। ১০৫ বছরে তিনি এখন কলকাতাতেই। তাঁর স্মৃতি, কথা বলায় সময়ের পলি জমেছে অতি সম্প্রতি। তবে শিবব্রতকে একটু উসকে দিলেই তিনি অনায়াসে ডুব দেবেন ১৯৪০-এর দশকে। ১৯৪১ থেকে নানা স্বদেশি কারবারে জড়িয়ে। ফরোয়ার্ড ব্লকের লীলা রায়, অনিল রায়, সত্যরঞ্জন বক্সী থেকে পরে শরৎচন্দ্র বসু, অতুল্য ঘোষদেরও সান্নিধ্যে এসেছেন। বার চারেক জেল খেটেছেন। সুভাষচন্দ্র বসুর অন্ধ অনুরাগী। বলেন, “এক বার গভর্নর জেনারেলকে মারার জন্য আমি হাতে বোমাও নিয়েছিলাম। ইডেনে মিটিং ছিল। ক্যালকাটা মাঠের অফিসের বেসিনে বোমা লুকিয়ে রাখি। কিন্তু পরে মনে হল, কাজটা ঠিক হবে না! লাভ কী! এক গভর্নর মরলে আর এক জন আসবে। তা ছাড়া তখনকার রাজনীতিতে বোমা, গুলি নয়, লোকজনকে সচেতন করায় জোর দিতেন লীলা রায়েরা।”
পুলিশের তাড়া খেয়ে অবশ্য গোটা ভারতে গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে হয়েছিল শিবব্রতকে। বললেন, “পুলিশ ভেবেছিল আমার সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের যোগাযোগ আছে। তাই কলকাতা থেকে পটনা, লাহোর পালিয়েও শান্তি নেই। পুলিশ ঘুরছে বাঙালিবাবুর খোঁজে। লাহোরে সেজমামা বলল, তুই যা, তোর জন্য আমার চাকরিটা যাবে। আমি পালিয়ে দিল্লি স্টেশনে থেকেছি। মন্দিরে খেতাম। এক পোশাক, গায়ে গন্ধ! আমার মা জানলে কেঁদে অস্থির হতেন!” পরে দিল্লি থেকে কলকাতায় ফেরার পথে ট্রেনে ধরা পড়েন। শিবব্রতের এখনও মনে আছে, প্রেসিডেন্সি জেলে ৪৪টা সেলওয়ালা উইংয়ের ৩৪ নম্বর ঘরে থাকতেন। বলেন, “মনে আছে মশারি খাটানোর পেরেক দিয়ে দেওয়ালে লেখা, ‘আগামীকাল আমাদের আন্দামানে নিয়ে যাবে’! অথবা ‘ব্রিটিশ সরকার শেষ হোক’। আমি চেয়েছিলাম, এগুলো রক্ষা করা হোক। কিন্তু পরে এসে দেখেছি কিছুই হয়নি।”
স্বাধীনতার পরে যাদবপুরের ইঞ্জিনিয়ার চাকরিসূত্রেই ১৯৫৪ থেকে জার্মানিবাসী। কিন্তু দেশের মাটির সঙ্গে যোগ আলগা হয়নি। “বাবা কিন্তু হামবুর্গে মূর্তিমান ভারত”, বলছিলেন শিবব্রতের পুত্র সৌম্যব্রত। তাঁর হামবুর্গে জন্ম। স্ত্রী জার্মান। তবু সৌম্যও ভারতীয় নাগরিকত্বের পরিচয়টাই রেখেছেন। বাবার আবেগের ছোঁয়াচ।
কিন্তু কেন দেশে ফেরেননি? ভিডিয়ো ক্লিপ মারফত শিবব্রত বললেন, “যুদ্ধের সময়ে সুভাষচন্দ্র এখানে একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন। জার্মান ভারত সমাজ। তাঁর সঙ্গে যাঁরা কাজ করেছেন তাঁদের কিছু লোক এখানে ছিলেন। আমি কয়েক জনকে দেখেছি। কী ভাবে ভারতবর্ষের প্রচার করা যায়, কথা বলেছি! আমি এখানে দেশের প্রচারেই থেকে গেলাম!” নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড থেকে ভারত-বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা, অনুষ্ঠানে জার্মানিতে জড়িয়েছেন শিবব্রত। ২০০৭-এ রাষ্ট্রপতি এপিজে আব্দুল কালামের হাত থেকে প্রবাসী ভারতীয় সম্মাননা নেন। জার্মানির রাষ্ট্রীয় সম্মান বুনডেশফেরডিনস্ট ক্রয়েজ স্বীকৃতিও পেয়েছেন।
প্রিয় দেশ নিয়ে কিছু আক্ষেপও অবশ্য আছে। শিবব্রত বললেন, “সুভাষচন্দ্র না-থাকায় বাংলার ক্ষতি হয়েছিল। বাংলাদেশকে দু’ভাগ করায় জওহরলাল নেহরুরা খুব দুঃখিত হননি।” পুত্র সৌম্যব্রতের সাহায্যে এখনও তাঁর জন্মভিটে আড়কান্দি গ্রাম, চন্দনা নদীর তীর গুগল ম্যাপে খোঁজেন প্রবীণ। মানচিত্রে না-থাকুক সেই দেশ তাঁর চোখের মণিতে অটুট।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy