ভোটের আগে বিজেপির বিরুদ্ধে আক্রমণে শান প্রশান্ত কিশোরের। অলঙ্করণ: শৌভিক দেবনাথ।
শুধু জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) নয়, নাগরিক সংশোধনী বিল (সিএবি)কেও ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে হাতিয়ার করতে চাইছে তৃণমূল। এ বার তেমন ইঙ্গিতই দিলেন ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোর। তৃণমূলে নির্বাচনী কৌশলের দায়িত্বে থাকা প্রশান্তের মতে, আগামী দিনে এনআরসি এবং নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল— কেন্দ্রের হাতে ভয়ঙ্কর অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে। এত দিন যেখানে বিজেপির বিরুদ্ধে তৃণমূলের অস্ত্র ছিল শুধুই এনআরসি, প্রশান্তের বার্তায় স্পষ্ট, এ বার সিএবিকে সঙ্গে নিয়েই জোড়া আক্রমণের পথে যাবে ঘাসফুল।
সিএবি নিয়ে বিজেপি এ রাজ্যে প্রচারের ঝড় তুলতে পারে, এমনটাই মনে করছেন রাজনৈতিকমহলের একাংশ। ওই অংশের মতে, এনআরসি নিয়ে যে আতঙ্কের কোনও কারণ নেই, সিএবিকে হাতিয়ার করে মানুষকে সেটাই বোঝাতে চাইবেন বিজেপি নেতৃত্ব। ভোট কুশলী প্রশান্ত কিশোর সেই আভাস পেয়েই বিজেপির ওই ‘হাতিয়ার’ মানুষের কাছে ‘ব্যুমেরাং’ হয়ে আসবে বলে পাল্টা বোঝাতে চাইছেন। এনআরসির সঙ্গে সিএবিকে জুড়ে দিয়েই তিনি তাই বিজেপিকে জোড়া ফলায় বিদ্ধ করার কৌশল নিয়েছেন। এমনটাই মত ওই অংশের।
অসমে এনআরসির কারণে গত কয়েক মাসে একাধিক বার প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে বিজেপি নেতৃত্বকে। সম্প্রতি বাংলার উপনির্বাচনে বিজেপিকে তিন কেন্দ্রে তৃণমূলের কাছে হারতে হয়েছে। রাজনৈতিক মহলের ওই অংশের মতে, বিজেপিকে এনআরসি প্যাঁচে ফেলতে তৃণমূল উপনির্বাচনের প্রচারে যে সব অস্ত্র ব্যবহার করেছিল, তা মূলত প্রশান্তেরই ‘কৌশল’। উপনির্বাচনে তাঁদের খারাপ ফল যে মূলত এনআরসি ইস্যুতে, তেমনটা মনে করেন বিজেপি নেতৃত্বের একাংশও। তাই ভেবেচিন্তেই সিএবিকে তুরুপের তাস করতে চেয়েছিল বিজেপি। অতি তৎপরতার সঙ্গে সোমবার লোকসভার পর বুধবার রাজ্যসভাতে বিলটি পাশও করিয়ে নিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ। বিল নিয়ে সংসদে আলোচনায় তাই ঘুরেফিরে অমিত শাহের মুখে বাংলার কথা উঠে এসেছিল। নয়া আইন চালু হলে বাংলার ছিন্নমূল মানুষ কী ভাবে উপকৃত হবেন, বারে বারে তার ব্যাখ্যা দিতেও শোনা গিয়েছে অমিতকে।
আরও পড়ুন: নাগরিকত্ব বিল পাশের জের! আচমকা ভারত সফর বাতিল করলেন বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী
এনআরসি ইস্যুকে সামলাতে বিজেপি নেতৃত্ব যখন সিএবিকে ঢাল করে এগোচ্ছেন, তখন সেই ঢালের উপরেও জোড়া আক্রমণ শানাতে চাইলেন কুশলী প্রশান্ত। বৃহস্পতিবার নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল নিয়ে টুইট করেছেন তিনি। সেখানে প্রশান্ত লিখেছেন, ‘‘বলা হচ্ছে, নাগরিক সংশোধনী বিলের মাধ্যমে নাকি শুধুমাত্র নাগরিকত্ব দেওয়া হবে, কারও কাছ থেকে তা কেড়ে নেওয়া হবে না। কিন্তু আসল সত্যিটা হল, এনআরসি এবং নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল, সরকারের হাতে ভয়ঙ্কর জোড়া অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে। যার মাধ্যমে বৈষম্য তো বটেই, ধর্মের ভিত্তিতে মানুষকে বিচার করা যাবে।’’ সংসদে বিল পাশ হয়ে গেলেও হার মানছেন না বোঝাতে টুইটারে #নটগিভিংআপ-ও লেখেন তিনি।
প্রাণ থাকতে বাংলায় এনআরসি হতে দেবেন না বলে এর আগে একাধিক বার জানিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কাউকে ভিটেছাড়া হতে দেবেন না বলেও দাবি করেছেন তিনি। এই কৌশলের পিছনে প্রশান্তের মস্তিষ্ক যে রয়েছে, তা মেনে নিয়ে রাজনৈতিক শিবিরের ওই অংশের মত, মূলত মমতার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েই এনআরসি আতঙ্ক কাটাতে বাংলার মানুষের কাছে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে উঠেপড়ে লেগেছেন বিজেপি নেতৃত্ব। যে অস্ত্রে মমতাকে মাত দিতে চাইছে বিজেপি, এ বার সেই সিএবি অস্ত্রেই গেরুয়া শিবিরকে পাল্টা আঘাত করতে চাইছেন প্রশান্ত। তাঁর টুইটে সেই বার্তাই স্পষ্ট বলেই মনে করছে রাজনৈতিকমহলের ওই অংশ। তাঁদের মতে, বিজেপি যদি সিএবি দিয়ে মানুষকে বোঝাতে সক্ষম হয়, এনআরসিতে তাদের কোনও ক্ষতি হবে না, তাতে ক্ষতি তৃণমূলেরই। তাই ভোটের ময়দানে বিজেপিকে কুপোকাত করতে আগামী দিনে তৃণমূল শিবির যে এনআরসি-র সঙ্গে সিএবিকে জুড়েই যৌথ হানা চালাবে, তা নিয়ে নিঃসংশয় ওই মহল। সে বার্তা কয়েক দিন আগেই মিলেছে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গলাতেও। তিনি বলেছিলেন, ‘‘এনআরসি, সিএবি আসলে একই মুদ্রার দু’পিঠ।’’
We are told that #CAB is bill to grant citizenship and not to take it from anyone. But the truth is together with #NRC, it could turn into a lethal combo in the hands of Government to systematically discriminate and even prosecute people based on religion.#NotGivingUp
— Prashant Kishor (@PrashantKishor) December 12, 2019
প্রশান্ত কিশোরের টুইট।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক তথা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক উদয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়েরও একই মত। তিনি বলছেন, ‘‘সিএবি এবং এনআরসি-কে আলাদা করে দেখার কোনও মানে হয় না। একটা ছাড়া আর একটা অসম্পূর্ণ। এনআরসি-র মতো কোনও কর্তৃপক্ষ গঠিত না হলে সিএবির রূপায়ণ ঘটানোই যাবে না। আর এনআরসির মাধ্যমে সিএবির রূপায়ণ যে মুহূর্তে ঘটবে, সেই মুহূর্তে সংবিধানের ১৪ অনুচ্ছেদ লঙ্ঘিত হবে। ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকে-নাগরিকে বৈষম্য তৈরি হয়ে যাবে।’’
বিজেপি এই যুক্তি মানতে নারাজ। বিজেপি নেতারা বলছেন, সিএবি তো শরণার্থীদের জন্য, এটা তো নাগরিকদের জন্য নয়। তা হলে ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য তৈরি করা হচ্ছে কোথায়?
উদয়নের ব্যাখ্যা, ‘‘ধরুন জনার্দন চট্টোপাধ্যায় ঘটি, রামেন্দু সিংহরায় বাঙাল। ধরে নিলাম সিএবির সুবাদে এঁদের দু’জনের কাউকেই ভারতীয়ত্বের প্রমাণ দিতে হবে না। কিন্তু ধরুন, আব্দুল লতিফের পরিবার স্বাধীনতার আগে থেকেই এ দেশে রয়েছে। আর জব্বর শেখ অনেক পরে বাংলাদেশ থেকে এসেছেন। এনআরসি হলে তাঁদের দু’জনকেই তো নথিপত্র নিয়ে লাইনে দাঁড়াতে হবে। ভারতীয়ত্বের প্রমাণ দিতে হবে। না হলে তো বোঝার কোনও উপায় নেই যে, কে ভারতীয় মুসলমান আর কে পরে এসেছেন। এটা বৈষম্য নয়? ভারতের হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, পার্সি, খ্রিস্টান নাগরিকদের কোনও প্রমাণ দিতে হবে না। আর ভারতীয় হওয়া সত্ত্বেও আব্দুল লতিফকে প্রমাণ দাখিল করতে হবে, কারণ, তিনি মুসলমান। এটা বৈষম্য নয়?’’
আরও পড়ুন: চিন্তা নেই অসম, টুইট মোদীর ॥ কং খোঁচা, নেট নেই পড়বে কী করে?
তবে এর আগেও প্রশান্ত সিএবি নিয়ে তাঁর বক্তব্য জানিয়েছিলেন। গত সোমবার লোকসভায় নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলকে সমর্থন জানানোয়, সংযুক্ত জনতা দল (জেডিইউ) সহ-সভাপতি হিসাবে নিজের দলকেই একহাত নিয়েছিলেন প্রশান্ত। টুইট করেছিলেন, ‘‘যে নাগরিকত্ব বিল ধর্মের নিরিখে মানুষের অধিকার বিচার করে, জেডিউ-কে তাতে সমর্থন জানাতে দেখে আমি হতাশ। দলের সংবিধানের প্রথম পাতাতেই যেখানে তিন বার ধর্ম নিরপেক্ষ কথাটির উল্লেখ রয়েছে, দলের নেতারা যেখানে গাঁধীর আদর্শে অনুপ্রাণিত, এই সিদ্ধান্ত সেখানে বেমানান।’’
তবে, সবের পিছনেই রাজনৈতিক মহল আসলে প্রশান্তের ভোট কুশলী পরিচয়কেই বড় করে দেখতে চাইছেন। তাঁদের মতে, প্রশান্তের আসল পরিচয় জেডিইউয়ের সহ সভাপতি নয়, তিনি ভোট কুশলী। তাঁর বার্তা যে মূলত এ রাজ্যে ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়েই, তা নিয়ে নিঃসংশয় রাজনৈতিক শিবির।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy