সৈকতের দখল কার্যত যানবাহনের। ছবি: সোহম গুহ।
বছর পনেরো আগে, মন্দারমণির প্রায় নিঝুম সৈকতে টিমটিম করা হোটেলটির দেওয়ালে ঝলমলে বিজ্ঞাপনটা কিন্তু চোখ এড়াত না—‘সমুদ্রের বুকে গাড়ি চালানোর মজা লুঠতে আসুন মন্দারমণি।’
দেড় দশক পেরিয়ে গিয়েছে। মন্দারমণির সমুদ্র ছুঁয়ে এখন ৮৩টি হোটেল-রিসর্টের ভিড়। ঢেউ ভেঙে গাড়ি-বাইক চালানোর উচ্ছ্বাসের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে, প্যারাসেলিং, ওয়াটার-স্কুটারের বিনোদন। যার বৈধতা ঘিরে প্রশ্নটা উঠেছে কিছু দিন আগে।
এ বার মন্দারমণির সৈকতে পর্যটনের বৈধতা নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিল কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ মন্ত্রক।
পর্যটক টানতে, দেশের যে ১৯টি সৈকত শহর উপকূল-বিধির তোয়াক্কা করেনি, মন্দারমণি সেই তালিকার উপরের দিকেই রয়েছে বলে সম্প্রতি দিল্লির ওই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। পূর্ব মেদিনীপুরের ওই পর্যটন কেন্দ্র নিয়ে পরিবেশ মন্ত্রকের তাই প্রশ্ন—পর্যটনের প্রসার মানেই কি সৈকত বিপন্ন করে পরিবেশের ভারসাম্য ক্ষুণ্ণ করা?
প্রশ্নটা সামনে রেখে, এ বার রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে জাতীয় পরিবেশ আদালতে মামলারও তোড়জোড় শুরু করেছেন পরিবেশবিদ সুভাষ দত্ত।
তিনি বলছেন, ‘‘পর্যটনের নেশায় এমন মেতে রয়েছে রাজ্য সরকার যে, সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলের নিয়ম বিধি (সিআরজেড) অবজ্ঞা করা অতি তুচ্ছ ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে।’’
বছর কয়েক আগে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের রিপোর্ট হাতে পেয়ে এ প্রশ্ন তুলেছিল হাইকোর্টও। সেই নির্দেশিকায় স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল—সিআরজেড-এর নিয়ম ভেঙে ওই সৈকতে যে নির্মাণ হয়েছে সেখানে ব্যবসা করা চলবে না। মন্দারমণির সৈকতে নতুন করে আর কোনও নির্মাণের উপরেও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল হাইকোর্ট।
তবে, আদালতের কড়া ফতোয়া সত্ত্বেও মন্দারমণির সমুদ্র ছুঁয়ে নিত্যনতুন হোটেল নির্মাণে ছেদ পড়েনি। চলছিল সৈকত জুড়ে গাড়ি-বাইকের দাপাদাপিও। সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের তা নিয়ে অবশ্য কোনও হেলদোল ছিল না। বরং পালাবদলের পরে, দিঘা-মন্দারমণিতে তাঁর প্রথম সফরেই মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছিলেন—‘যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে, বিচের (সমুদ্রতটে) উপরে ঘর-বাড়ি আর না বানালেই হল।’ ওই বছরে, ডিসেম্বর মাসে দিঘা-মন্দারমণি গিয়ে রাজ্যের দুই মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস এবং কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরী প্যারাসেলিং, বিচ বাইকের মতো বেশ কিছু ওয়াটার স্পোর্টস চালু করে এসেছিলেন।
সৈকতের বুকেই নির্মাণ আর যথেচ্ছ দাপাদাপির উপরে কার্যত সরকারি সিলমোহর পড়ে যাওয়ায় তার বৈধতা নিয়ে আর প্রশ্ন তোলার ঝুঁকি নেয়নি স্থানীয় প্রশাসন বা দিঘা-শঙ্করপুর উন্নয়ন পর্ষদের (ডিএসডিএ) কর্তারা।
মন্দারমণির সৈকত যে ক্রমেই উপকূল-আইন ভাঙার আঁতুরঘর হয়ে উঠছে, দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের রিপোর্টে তা প্রথম তুলে ধরেছিলেন দফতরের তৎকালীন মুখ্য আইন অফিসার বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়। তিনি বলছেন, ‘‘২০০৪-এ প্রথমবার মন্দারমণি গিয়েই আঁচ করেছিলাম, বালিয়াড়িতে গাড়ি চলাচল শুরু হলে জীব বৈচিত্র্য ভেঙে পড়তে সময় লাগবে না।’’ অনুমান ভুল ছিল না। ২০০৬ সালে পর্ষদের রিপোর্ট বলছে—মন্দারমণির সমুদ্র ছোঁয়া ৫৩টি হোটেল এবং বালিয়াড়ি জুড়ে গাড়ির দাপাদাপিতে হারিয়ে যাচ্ছে, দু’টি অপরিহার্য় প্রাণী, লাল কাঁকড়া এবং সমুদ্র-মাকড়সা।
উপকূল আইন অনুসারে জলোচ্ছ্বাসের সময় সমুদ্র যতটা এগিয়ে আসে, অর্থাৎ হাই টাইড জোনের ৫০০ মিটারের মধ্যে কোনও স্থায়ী নির্মাণ করা যাবে না। অথচ সেই সময়ে মন্দারমণির প্রায় সব হোটেলই ছিল একেবারে সমুদ্র ছুঁয়ে।
২০০৬ সালে পর্ষদের আপিল আদালত তাই ৮টি হোটেল বন্ধ করার নির্দেশ দেয়। নিষেধাজ্ঞা জারি হয় নতুন নির্মাণের উপরেও। পরের বছর, পর্ষদের উপরেই দায়িত্ব সঁপে হাইকোর্ট জানিয়ে দেয়, উপকূল-বিধি মেনে চলার ব্যাপারে নির্দেশিকা জারি করতে হবে জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারকে। তবে এর পরেও বিধি ভেঙে পর্যটন প্রসারে দাঁড়ি পড়েনি। বছর কয়েকের মধ্যেই আড়েবহরে বেড়ে ওঠা মন্দারমণিতে হোটেল সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৩টি।
বিধি ভেঙে হোটেল তৈরির বিরাম নেই জানতে পেরে, তিন বছর আগে ফের পর্ষদ এবং সিআরজেড কর্তৃপক্ষকে নজরদারির নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট।
নজরদারির সেই অনুশাসনে যে ফল মেলেনি, পরিবেশ মন্ত্রকের সাম্প্রতিক রিপোর্ট তারই প্রমাণ। সুভাষবাবু বলছেন, ‘‘সিআরজেড বা হাইকোর্টের রায় তেমন আশানুরূপ ফল পাওয়া গেল না। এ বার তাই পরিবেশ আদালতের শরণাপন্ন হচ্ছি।’’ সেই ভরসাতেই দিন গুনছে মন্দারমণি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy