Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Sand Mining

অবাধে বালি তুলে নদীর দফারফা

সরকার আছে। আইন আছে। তবু কেউ নেই প্রকৃতি, পরিবেশের। মানুষের। বিষ জল, স্থল, বাতাসে।সবচেয়ে বিপজ্জনক অবশ্য যন্ত্র ব্যবহার করে নদী গর্ভে ৩০-৪০ ফুট গর্ত খুঁড়ে বালি তোলার অভ্যাস।

নলহাটির বৈধরায় ব্রাহ্মণী নদী থেকে এ ভাবেই তুলে নেওয়া হয় বালি। মাঝেমধ্যে অভিযান হয়। তার পরে আবার বালি তোলা শুরু। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম

নলহাটির বৈধরায় ব্রাহ্মণী নদী থেকে এ ভাবেই তুলে নেওয়া হয় বালি। মাঝেমধ্যে অভিযান হয়। তার পরে আবার বালি তোলা শুরু। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম

দয়াল সেনগুপ্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০২০ ০৫:৩৫
Share: Save:

বর্ষার পরে ময়ূরাক্ষীর জল কমলে নদী পেরিয়ে ওপারে শাল জঙ্গল থেকে পাতা সংগ্রহ করতে যেতেন সিউড়ি ১ ব্লকের কাঁটাবুনি গ্রামের ঢাঙি মুর্মু, লক্ষ্মী সরেনরা। গত কয়েক বছর ধরে সে রাস্তা বন্ধ। লক্ষ্মী বলছিলেন, ‘‘বালি তোলার ফলে নদীর বুকে তৈরি হয়েছে পেল্লায় সব গর্ত। সেখানে তলিয়ে গেলে প্রাণ বাঁচানোই দায়। তাই ও পথে আর পা বাড়াই না।’’

শুধু ঢাঙি মুর্মু ও লক্ষ্মী সরেনদের জীবিকাই নয়, নদী থেকে নিয়ম না-মেনে অবাধে বালি তোলায় বিপদের মুখে বীরভূমের বিরাট তল্লাটের জীবনযাত্রা ও পরিবেশ। নদী বিশেষজ্ঞ থেকে পরিবেশকর্মী সকলেই বলছেন, নদী পাড়ের বৃক্ষচ্ছেদন, ইটভাটা করতে গিয়ে পাড় কেটে ‘ক্যাচমেন্ট’ এলাকা (গড়ানো বৃষ্টির জল যে এলাকা থেকে নদীগর্ভ পড়ে) নষ্ট করে দেওয়া, বর্জ্য ফেলার মতো অত্যাচার তো আছেই। তবে সবচেয়ে বিপজ্জনক, মুনাফার লোভে নদীবক্ষ থেকে অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বালি তোলা। এর ফলে নদীতে জলের স্রোত এবং স্বাভাবিক গতি রুদ্ধ হচ্ছে। হারাচ্ছে জীববৈচিত্র্য। সচেতন না হলে এবং প্রশাসন দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে এর পরিণাম ভয়াবহ হবে—সতর্ক করে দিচ্ছেন পরিবেশকর্মীরা।

জাতীয় পরিবেশ আদালেতের নির্দেশে নদীবক্ষ থেকে ইচ্ছেমতো বালি তোলায় ২০১৬ সালেই নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। ই-অকশনের মাধ্যমেই নদী থেকে বালি তোলার অধিকার অর্জন করেন লিজপ্রাপ্তেরা। বীরভূম জেলায় বৈধ বালি ঘাটের সংখ্যা ১৪৩টি। সেগুলির একটি রয়েছে ব্রাহ্মণী নদীতে। বাকিগুলি সব অজয় এবং ময়ূরাক্ষীতে। সেই ‘বৈধতা’কে ঢাল করে অজয়, ময়ূরাক্ষী থেকে বেহিসেবি বালি ‘লুট’ চলছে বলে অভিযোগ। আবার হিংলো, শাল, সিদ্ধেশ্বরী, কুশকর্ণিকা, দ্বারকার মতো ছোট নদ-নদী থেকেও বালি তোলা হচ্ছে অবাধে। বাসিন্দাদের অভিযোগ, এ ক্ষেত্রে প্রশাসনের কারও কারও সঙ্গে ‘যোগসাজশ’ না থাকলে বেআইনি এ সব কাজকর্ম বছরের পর বছর চলে কী করে?

সবচেয়ে বিপজ্জনক অবশ্য যন্ত্র ব্যবহার করে নদী গর্ভে ৩০-৪০ ফুট গর্ত খুঁড়ে বালি তোলার অভ্যাস। ওই গর্তে তলিয়ে জেলায় একাধিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। তবুও সতর্ক হওয়ার নাম নেই। বেহিসেবি বালি তোলার জন্যই পরিবেশের বিপদ বাড়ছে বলে জানাচ্ছেন পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত। তাঁর কথায়, ‘‘অধিকার পেয়েছি বলেই যা খুশি তাই করা যায় না। নিয়ম মেনে ও নদীর ঢাল বজায় রেখেই বালি তুলতে হবে।’’ তাঁর মতে, যথেচ্ছ বালি তোলা ঠেকাতে যতটা না প্রয়োজন সচেতনতা, তার চেয়েও বেশি জরুরি লাগাতার প্রশাসনিক নজরদারি।

একই কথা বলছেন বিশ্বভারতীর ভূগোলের অধ্যাপক মলয় মুখোপাধ্যায়। যান্ত্রিকতা বা আধুনিকতার ধাক্কায় নদীর সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ, নির্ভরতা কতটা বদলেছে, তা দেখতে বীরভূম বহমান তিনটি নদী— শাল, অজয় এবং ময়ূরাক্ষীর উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত সমীক্ষা চালিয়েছেন মলয়বাবু। তিনি বলছেন, ‘‘নদীর যে কী ক্ষতি হয়েছে, বলে বোঝানো সম্ভব নয়! নদীর তলদেশে যদি এ ভাবে বড় বড় গর্ত করে দেওয়া হয়, তাতে স্রোত এলোমেলো হয়ে যায়। জীববৈচিত্র তো নষ্ট হয়ই। বর্ষার সময় ওই গর্তে ঘূর্ণি তৈরি হয়। বন্যা হলে যা নদীর গতি পথ বদলে দিতে পারে। কিন্তু সে কথা ভাবা হচ্ছে না।’’

অবৈধ ভাবে বালি তুলে পরিবেশ নষ্ট করার অভিযোগে এবং ভূমিক্ষয় রোধে পরিবেশ আদালতের নির্দেশক্রমে ময়ূরাক্ষী ও দ্বারকার দু’পাড়ে ৩০ হেক্টর গাছ লাগানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল চলতি বছরেই। কিন্তু, বরাদ্দ না-আসায় সেটাও করা যায়নি। মলয়বাবু অবশ্য বলছেন, ‘‘বনসৃজন করেও বিপদ আটকানো যাবে না। কারণ একটি গাছ বেড়ে উঠতে অন্তত ১৫ -২০ বছর সময় লাগে।’’ নদীর ধার ঘেঁষে ইটভাটা গড়ে ওঠা নিয়েও উদ্বিগ্ন তিনি। ‘‘নির্মাণ শিল্প নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। যাতে বালি কম ব্যবহৃত হয়। তা না হলে নদী বাঁচানো যাবে না!’’—স্পষ্ট বলে দিচ্ছেন মলয়বাবু।

বীরভূমের অতিরিক্ত জেলাশাসক (ভূমি ও ভূমি সংস্কার) শুভ্রজ্যোতি ঘোষ অবশ্য বলছেন, ‘‘নদীর নাব্যতা বজায় রাখতেও বালি তোলার প্রয়োজন আছে। তাতে এক দিকে যেমন প্রাকৃতিক সম্পদ কাজে লাগে, তেমনই আয়ের উৎস হতে পারে।’’ কিন্ত কতটা বালি তোলা উচিত, তা কি মানা হয়? তাঁর জবাব, কোন ব্লকগুলিতে দীর্ঘমেয়াদি মাইনিং লিজ দেওয়া যাবে, পরিবেশ বিষয়ক একটি সংস্থার পরামর্শ মেনেই তা দেওয়া হয়েছে। পরিবেশ বজায় রেখে কী ভাবে বালি তোলা হবে সেটাও লিজ নেওয়ার সময় সময় বলা হয়। সেটা মানলে ক্ষতি হবে না নদীর বা পরিবেশের। একই সঙ্গে তিনি মানছেন, ‘‘সব ক্ষেত্রে নিয়ম মানা হচ্ছে এটা বলছি না। তবে প্রশাসন যথাসম্ভব নজরদারি চালাচ্ছে।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Sand Mining Rivers
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy