চিদম্বরম ভুল স্বীকার করেছেন। এ রাজ্যের নেতা-নেত্রীরাও করবেন কি?
নিজের লেখা ‘দ্বিখণ্ডিত’ নিষিদ্ধকরণ নিয়ে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের দিকে এমন প্রশ্নই ছুঁড়ে দিলেন তসলিমা নাসরিন। যার জবাবে বুদ্ধবাবু জানালেন, তিনি কোনও সময়েই বই নিষিদ্ধ করার পক্ষে নন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তখন ওই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
রাজীব গাঁধী জমানায় সলমন রুশদির উপন্যাস ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ নিষিদ্ধ করা ভুল হয়েছিল বলে গত কালই দাবি করেছিলেন কংগ্রেস
নেতা চিদম্বরম। যার পরিপ্রেক্ষিতে সলমন রুশদি টুইট করে বলেছিলেন, ‘‘২৭ বছর পরে এই স্বীকারোক্তি। এই ভুল শোধরানোর আগে আরও ক’টা ভুল হবে?’’
চিদম্বরমের এই ভুল স্বীকার দেখে টুইটারে আজ মুখ খুলেছেন তসলিমা নাসরিনও। আজ থেকে প্রায় ১২ বছর আগে অর্থাৎ ২০০৩ সালের ২৮ নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গে নিষিদ্ধ করা হয় তসলিমার লেখা বই ‘দ্বিখণ্ডিত।’ সেই স্মৃতি উস্কে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টচার্যকে টুইটারে তসলিমার সরাসরি প্রশ্ন: ‘‘পি চিদম্বরম বলেছেন, ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কবে বলবেন আমার বই ‘দ্বিখণ্ডিত’ নিষিদ্ধ করাও ভুল ছিল?’’
তসলিমার টুইট প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে বুদ্ধবাবু আজ বলেছেন, ‘‘বিতর্ক খোঁচাতে চাই না। তবে আমি মৌলিক ভাবে কখনও কোনও বই নিষিদ্ধ করার বিপক্ষে। ব্যক্তিগত ভাবে আমি এ ভাবে ভাবিই না। কিন্তু এই বইটার (দ্বিখণ্ডিত) সময় মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বাধ্য হয়েছিলাম।’’
বুদ্ধবাবুর বক্তব্যে সমর্থন জানিয়ে সিপিএমের দলীয় সূত্রেও দাবি করা হয়েছে, ওই সময় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভাল ছিল না। শহরের বেশ কিছু বিশিষ্ট জনের কাছে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য জানতে
চেয়েছিলেন, কী করব? সেই বিশিষ্ট জনদের বেশির ভাগ যা চেয়েছিলেন, সেটাই হয়েছিল। সিদ্ধান্তটা ঠিক ছিল কি না, সে প্রশ্ন পরেও তাড়িয়ে বেড়িয়েছে বলেও সিপিএম নেতাদের একাংশের দাবি।
এক যুগ আগে ওই সিদ্ধান্ত যখন কার্যকর করার কথা ভাবা হচ্ছে, তখনও এই প্রশ্ন করা হয়েছিল তদানীন্তন শাসককে। বুদ্ধবাবু তখন বলেছিলেন, ‘‘আমি নিজে বইটা পড়েছি। বইটা তাঁদেরই পড়িয়েছি, যাঁদের মতামতের গুরুত্ব আছে। তার পরে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’’ গণতান্ত্রিক দেশে কোনও বই নিষিদ্ধ করা লেখক-শিল্পীর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ কি না, তা জানতে চাওয়া হলে সে সময়ে বুদ্ধদেব কিন্তু নিরুত্তর ছিলেন। সিপিএমের সেই সময়কার রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাস বলেছিলেন, ‘‘বইটি সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে বলে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সরকার আগাম সতর্কতা হিসেবে এই নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।’’
রাজনীতির পর্যবেক্ষকরা অবশ্য রুশদি-তসলিমার প্রসঙ্গটিকে এখনকার পরিস্থিতির থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে রাজি নন। তাঁদের বক্তব্য, অসহিষ্ণুতা নিয়ে মোদী সরকারকে লাগাতার আক্রমণ করছেন বিরোধীরা। সেই বাধ্যবাধকতা থেকেই পুরনো ‘অসহিষ্ণুতা’ নিয়ে ভুল স্বীকারের হিড়িক। তাঁদের দাবি, চিদম্বরম এই কারণেই রুশদি নিয়ে মুখ খুলেছেন, সিপিএমও সেই পথেই তসলিমা নিয়ে সুর নরম করছে।
শুধু সিপিএম নয়, তসলিমার প্রশ্নে বিদ্ধ হয়েছেন বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। টুইটারে লেখিকা মমতার উদ্দেশে বলেছেন, ‘‘চিদম্বরমের কাছ থেকে শেখা উচিত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। ওঁর বলা উচিত, তসলিমার টিভি সিরিয়াল (দুঃসহবাস) নিষিদ্ধ করা ভুল হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা তুলে ওঁর উচিত সিরিয়ালটি সম্প্রচার করতে দেওয়া।’’
তসলিমাকে পরে এই প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে তিনি অভিযোগ করেন, ‘‘আমার ‘দুঃসহবাস’ নিয়ে যে একশো পর্বের ধারাবাহিক হওয়ার কথা ছিল, সেটা সংশ্লিষ্ট চ্যানেলে পুলিশ পাঠিয়ে মমতা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কলকাতা থেকে সব বিজ্ঞাপনও সরিয়ে দিয়েছিলেন।’’ তসলিমার এই বক্তব্য নিয়ে কী বলছেন তৃণমূল নেতৃত্ব? দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘দলে আলোচনা করে তবেই মতামত জানাতে পারব।’’
বস্তুত শুধু সিরিয়াল নয়, মমতা-জমানায় কলকাতা বইমেলায় তসলিমার বই ‘নির্বাসন’-ও প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার ঠিক এক বছর পরেই ঘটেছিল সেই ঘটনা। ২০১২ সালের কলকাতা বইমেলায় ‘নির্বাসন’ প্রকাশ হওয়ার কথা থাকলেও পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ডের নির্দেশে তা বাতিল হয়ে যায়।
বইটির প্রকাশক শিবানী মুখোপাধ্যায় তখন জানিয়েছিলেন, সরকারি ভাবে তাঁদের বলা হয় ‘অনুষ্ঠানস্থল প্রস্তুত করা যায়নি। তাই বই প্রকাশ করা যাচ্ছে না।’ তাঁর বক্তব্য ছিল, ‘‘অসমর্থিত সূত্রে
আমরা জেনেছিলাম তসলিমার বই বলেই এমন সিদ্ধান্ত। কারণ উনি নিষিদ্ধ লেখকদের তালিকায় পড়েন।’’ পরে বইমেলাতেই অন্য একটি স্টলে বইটি প্রকাশ করেন নবারুণ ভট্টাচার্য। তার পরের বছরই ‘কলকাতা লিটেরারি মিট’-এ সলমন রুশদিকে আসতে দেওয়া-না দেওয়া নিয়ে বিতর্ক বাধে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy