রাজপথে: শুভজিতের কাটআউট নিয়ে শহরে মিছিল। ছবি: সুজিত মাহাতো
হাতে হাতে প্ল্যাকার্ড। মুখে মুখে স্লোগান। মাঝে মধ্যেই ভিড় থেকে আকাশের দিকে ছুড়ে দেওয়া হচ্ছিল মুষ্ঠিবদ্ধ হাত। নিতান্ত ছাপোষা এক যুবককে জেল থেকে ছাড়াতে জেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে কাতারে কাতারে মানুষকে জেলা সদরে এসে এ ভাবে দাবি জানাতে পুরুলিয়া কবে দেখেছে, সে প্রশ্ন তুলে দিল নাগরিক কমিটির সমাবেশ।
জয়পুরের বাঁধডি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক শুভজিৎ মাহাতো পুলিশ গাঁজা পাচারের অভিযোগে গ্রেফতার করার পর থেকেই সোশ্যাল মিডিয়া থেকে রাস্তার ধারের দেওয়ালে ক্ষোভ আছড়ে পড়ছিল। শুক্রবার জনগণের সেই ক্ষোভের আঁচ পেল পুরুলিয়া। হাজার-হাজার মানুষ তাঁকে মিথ্যা মামলার অভিযোগে এ দিন প্রতিবাদ জানাতে এলেন। সেই ভিড়ে ছিলেন শিশু কোলে মা, স্কুল ইউনিফর্মে থাকা কচিকাঁচারা, ছিলেন টগবগে যুবকেরাও। তাঁদের হাতে প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘নির্দোষ শুভজিতের মুক্তি চাই’, কোনওটায় ছিল ‘পুলিশের মিথ্যা মামলা ও জুলুমবাজির প্রতিবাদ করুন’। শহরের রাজপথ প্রতিবাদী মানুষে মানুষে ছয়লাপ হয়ে গেল। কিন্তু সবই হল শান্তিপূর্ণ ভাবে।
২৯ নভেম্বর মুকুল রায়ের ছায়া সঙ্গী সুরজিৎ মাহাতোর ভাই শুভজিৎকে গ্রেফতার করার পরেই শাসকদল বাদে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এক সুরে অভিযোগ তোলেন— রাজনৈতিক প্রতিহিংসাবশত বরাবর সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে থাকা ওই যুবককে পুলিশকে দিয়ে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করানো হয়েছে। ঘটনার পরেই মুকুল রাজ্যে পুলিশরাজ চলছে বলে অভিযোগ তুলেছিলেন। এ দিন বর্ধমানে বিজেপি-র এক বৈঠকে তাঁর অভিযোগ, ‘‘আমার সঙ্গে থাকার জন্য বিনা অপরাধে জেলে ভরা হচ্ছে। পুরুলিয়ার শুভজিৎকে গাঁজার মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। অথচ ছেলেটি জীবনে গাঁজাই দেখেনি! এর প্রতিবাদে পুরুলিয়াতে ২৮ হাজার মানুষ পথে নেমেছেন।”
এ দিন পুরুলিয়া শহরের ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে পুরুলিয়া নাগরিক কমিটির মঞ্চে জেলার বিজেপি নেতাদের সঙ্গে আদিবাসী কুড়মি সমাজের নেতা থেকে কংগ্রেস নেতৃত্বও এক যোগে শুভজিৎকে গ্রেফতার করে পুরুলিয়ার সংস্কৃতির পরিপন্থী প্রতিহিংসার রাজনীতি শুরু করা হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন। যদিও মন্ত্রী তথা জেলা তৃণমূল সভাপতি শান্তিরাম মাহাতো দাবি করেছেন, ‘‘ঘটনাটি নিয়ে কিছু সংগঠন রাজনীতি করছে। তবে আমরা পুলিশকে বলব, এই ঘটনার যেন প্রকৃত তদন্ত করা হয়।’’ সে আশ্বাস দিয়েছেন পুলিশ সুপার জয় বিশ্বাসও। তিনি বলেন, ‘‘নাগরিক কমিটি আমার কাছে কয়েক দফা দাবিতে স্মারকলিপি দিয়েছে। ঘটনার তদন্ত হবে।’’
শুভজিতের মুক্তির দাবি জোরালো করতে রাজনৈতিক সভার প্রস্তুতির ধাঁচেই গ্রামে গ্রামে দেওয়াল লিখে, পোস্টার সাঁটিয়ে এ দিন পুরুলিয়া চলোর ডাক দিয়েছিল কমিটি। সকাল থেকেই শহরে মানুষ ঢুকতে শুরু করেছিল। দুপুরে তা জনপ্লাবনের চেহারা নেয়। হাত-কড়া পরা শুভজিতের কাটআউট নিয়ে সভায় যোগ দেন অনেকে।
মঞ্চেও ছিলেন জেলা কংগ্রেস সভাপতি নেপাল মাহাতো, পুরুলিয়ার কংগ্রেস বিধায়ক সুদীপ মাহাতো, জেলা কংগ্রেস সহ-সভাপতি উত্তম বন্দ্যোপাধ্যায়, আদিবাসী কুড়মি সমাজের নেতা অজিত মাহাতো, সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গৌতম মুখোপাধ্যায় থেকে বিভিন্ন মানুষজন। ছিলেন বিজেপি-র দুই সাধারণ সম্পাদক বিবেক রঙ্গা ও জ্যোতির্ময় সিংহ মাহাতো প্রমুখ। বিজেপি থেকে সদ্য বহিস্কৃত তিন নেতা রাজীব মাহাতো, নগেন্দ্র ওঝা ও সনাতন মাহাতোও ছিলেন।
সকলেই এক বাক্যে বলেছেন— এটা কোনও রাজনৈতিক সভা নয়। তাঁরা এক জোট হয়েছেন শুভজিতের মুক্তির দাবিতে। পুরুলিয়ায় প্রতিহিংসার রাজনীতির যে সংস্কৃতির আমদানি করা হচ্ছে, তা রুখতে তাঁরা সঙ্ঘবদ্ধ হচ্ছেন। নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক জন্মেঞ্জয় মাহাতোর কথায়, ‘‘বিবেকের ডাকেই স্কুল পড়ুয়া, গৃহবধূ থেকে বৃদ্ধ, হাজারে হাজারে যুবক এই প্রতিবাদ মিছিলে সামিল হয়েছেন।’’
শুভজিতের পাশে দাঁড়িয়েছে ঝাড়গ্রামও। এ দিন দুপুরে ঝাড়গ্রামের নতুন বাসস্ট্যান্ড থেকে শিবমন্দির পর্যন্ত মিছিল করে আদিবাসী কুড়মি সমাজের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা। ঝাড়গ্রামের বাসিন্দা সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক রাজেশ মাহাতো বলেন, ‘‘শুভজিৎকে মিথ্যা মামলায় পুলিশ ফাঁসিয়েছে। তাঁর মুক্তি চেয়ে আমরা তাই পথে নেমেছিলাম।’’ অজিতবাবু জানান, রাজ্যের অনেক জায়গার মানুষই শুভজিতের গ্রেফতারি মানতে পারছেন না। প্রতিবাদ চলছে।
মঞ্চে উঠে তাই শুভজিতের বাবা সুবোধ মাহাতো ছলছল চোখে জনাতে মনে করিয়ে দেন, সে দিন ভোরে পুলিশ বাড়িতে এসে মিথ্য কথা বলে তাঁর ছেলেকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। পরে মিথ্যা অভিযোগে তাঁকে ফাঁসিয়ে দিল। তিনি বলেন, ‘‘আমার ছেলে যখন বেকার ছিল, তখন গাঁজা পাচার করেনি। আর আজ সরকারি চাকরি পেয়ে ও গাঁজা পাচার করবে?’’ হাতজোড় করে তিনি এই ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy