নাগরিক সমাজের ডাকে নতুন নাগরিকত্ব আইন, এনআরসি ও এনপিআর বিরোধী সমাবেশ। বৃহস্পতিবার এসএন ব্যানার্জি রোডে। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।
কোনও তাবড় নেতানেত্রী মিছিলের ডাক দেননি। ছিল না রাজনীতির রং। শুধু সোশ্যাল মিডিয়ার কিছু বিক্ষিপ্ত ঘোষণা ছাড়া প্রচারের ঢাকঢোলও তেমন টের পাননি কেউই। বৃহস্পতিবার শীতের দুপুরের কলকাতা তবু প্রতিবাদের নানা রঙে সেজে উঠল। পার্ক সার্কাস রামলীলা ময়দান থেকে নিউ মার্কেট চত্বর লাগোয়া এসএন ব্যানার্জি রোড। গোটা পথ জুড়ে মানুষের অদ্ভুত মোহনা মুছে দিল শহর, গ্রাম, নামী-অনামীর সীমারেখা।
‘‘কী সব্বোনেশে আইন রে বাবা, বন্ধুদের মধ্যেই ফারাক করে দেবে। সেটা হতে দিচ্ছি না!’’ বন্ধু তাজুদ্দিন আহমেদ, ইমরান নাজ়ির, অমিত পালেদের পাশে হাঁটতে হাঁটতে উত্তেজনায় কাঁপছিলেন হাড়োয়ার সংগ্রাম চক্রবর্তী। হাড়োয়া, মিনাখাঁ, হাসনাবাদ থেকে শ’দেড়েকের দলটা ফেসবুক ছাড়াও এলাকায় একটা মিটিং থেকে খবরটা পেয়েছিলেন। তাতে সিপিএম, তৃণমূল সব দলের লোকই মিছিলে যাওয়ার পক্ষে সায় দিয়েছিল।
পেশায় ছোট ব্যাগের কারবারি সংগ্রামবাবু জীবনে কখনও কোনও দলের মিছিলে হাঁটেননি। তা হলে এ বার কেন আসতে হল? বছর পঁয়ত্রিশের যুবকের কথায়, ‘‘আমার বাবাও তো ’৬৫ সালে বাংলাদেশ থেকে এসেছেন। দুম করে ভোটার কার্ড বাতিল বলে ওরা কী শুরু করল, তার একটা বিহিত করতেই কলকাতা এসেছি।’’ সংগ্রামবাবুরা রাতে ফিরে গিয়েছেন বাড়িতে। কিন্তু মালদহ, শিলিগুড়ি থেকে আসা আরও অনেক মুখকে আগের রাত থেকেই শহরে রিপন স্ট্রিট, আনন্দ পালিত রোড বা শোভাবাজারে রাখার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন আহ্বায়করা।
আরও পড়ুন: ‘নিরপেক্ষ’ সংস্থার পর্যবেক্ষণে গণভোটের দাবি তুললেন মমতা
পুলিশি ব্যারিকেডের সামনে এসএন ব্যানার্জি রোডের পর অবশ্য এগোতে পারেনি মিছিল। তবু যেখানে থমকাল, ঠিক সেখানেই ফুলের পাপড়ির মতো প্রতিবাদের রং যেন এক উৎসব হয়ে উঠল। সেখানে জ্যোতিবা ফুলে বা অম্বেডকরের ছবি হাতে প্রতিবাদীর পাশেই মাদার টেরিজ়ার ভক্ত। সাতরঙা পতাকাধারী যৌন সংখ্যালঘু সমাজের প্রান্তিকের পাশে দৃপ্ত ভঙ্গিতে জাতীয় পতাকাধারী প্রবীণ মুসলমান। গ্রামের পাশে শহর। ‘সিএল’ নিয়ে হাজির স্কুল-কলেজের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সঙ্গে জেএনইউ, যাদবপুর, প্রেসিডেন্সি, আলিগড়, আলিয়া, ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের পড়ুয়া কিংবা প্রাক্তনীর ঝাঁক হাঁটল কাঁধে কাঁধ মিলিয়েই। ফেসবুকে বিক্ষিপ্ত ভাবে কেউ সমাজ বা দেশের কাছে দায়টুকু মনে করিয়ে দিয়েছিল। কেউ বলেছিলেন, ব্যক্তিগত অবসাদ, বিচ্ছিন্নতাবোধ ঝেড়ে ফেলতেই আসবেন। এনআরসি কিংবা নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতা যেন বুকের ভেতর জমাট-বাঁধা কষ্টের গুমোট থেকে গ্লানিমুক্তির কথাই ঘোষণা করে গেল।
নাগরিক সমাজের ডাকে নতুন নাগরিকত্ব আইন, এনআরসি ও এনপিআর বিরোধী সমাবেশ। বৃহস্পতিবার ধর্মতলায় । ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
রামলীলা ময়দান থেকে পথ চলা শুরু হতে বেলা একটা। রংতুলি সঙ্গে করে হাজির গার্ডেনরিচের রায়া দেবনাথ তত ক্ষণে প্রায় দেড়শো জনের গালে ‘নো এনআরসি’, ‘নো সিএএ’ লিখে ফেলেছেন। এসএন ব্যানার্জি রোড জুড়ে ঠাসা জনতা। কিছু বিশিষ্ট মুখ থাকলেও এ যেন মূলত অখ্যাত, অনামাদের মিছিল। হাঁটতে হাঁটতে গর্বিত বাবা নিজস্বী তুলছেন তাঁর তরুণী কন্যার সঙ্গে। মিছিলে সত্তরোর্ধ্ব মায়ের অদম্য মেজাজের ছবি সগর্বে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করছেন মেয়ে। প্রেমিক-প্রেমিকারা হাঁটছেন হাত ধরে। তথ্যচিত্র পরিচালক কস্তুরী কাকে চেঁচিয়ে বললেন, ‘‘ডিটেনশন ক্যাম্পে মানুষকে পরিবারছাড়া করে রাখার বিরুদ্ধেও এই প্রতিবাদ।’’ অনেক বছর বাদে প্রাক্তন ছাত্র ও যাদবপুরের শিক্ষিকার দেখা হচ্ছে। ইউনিভার্সিটি অব ইস্ট অ্যাঙ্গলিয়ায় ইতিহাসের শিক্ষিকা শিঞ্জিনী দাস, ইউনিভার্সিটি অব রেডিংয়ের শিক্ষক রোহন দেবরায়দের কাছে বড়দিনের ছুটিতে শিকড়ে ফেরাটা এক রকম অভাবনীয় অক্সিজেন দিয়ে গেল।
আরও পড়ুন: কিছু ট্রেন চলছে, বাদ কাঞ্চনকন্যা
জেএনইউ-এর বিখ্যাত আজ়াদি স্লোগানের পাশেই কোরাস গাইছিল, ‘সারে জহাঁ সে অচ্ছা।’ ‘এই দেশ সবার মাটি, নয়তো কারুর নয়’ বলছিল কবীর সুমনের গানের পোস্টার। গু-গা-বা-বা-র গানের স্বতঃস্ফূর্ত প্যারডি বলল, ‘‘ওরে মোদীরাজের সেনা তোরা ছাত্র মেরে করবি কী তা বল!’’ কলেজ পড়ুয়াদের হাত ধরে গোল হয়ে গান গাইলেন অপরিচিত দোকানদারেরা। এক যুগ আগের নন্দীগ্রামে ‘অপারেশন সূর্যোদয়’ বিরোধী দলহীন মিছিলের কথাও মনে পড়ছিল অনেকের। তবু প্রতিবাদীদের বৈচিত্র্যে এ মিছিল তার থেকেও আলাদা। বিকেল সাড়ে তিনটেয় ধর্মতলা চত্বরে নাগাড়ে স্লোগানের পরেও ক্লান্তি নেই। বিকেল চারটেয় বামেদের মিছিলে যোগ দিতে একটা দল ফের পার্কসার্কাসমুখী হল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy