আশিস কারক
সকাল সকাল দুটো হরলিক্স বিস্কুট খেয়ে বাড়ির দাওয়ায় বসে রয়েছে ছেলেটা। একটু চিন্তাও হচ্ছে। বন্ধুরা হাঁক দিয়ে গিয়েছে, ‘ইশকুলপানে চল, রেজাল্ট আছে বটে’ বলে। ঘুম থেকে উঠেই ওর মা পাশের বাড়িতে চলে গিয়েছে। কাকুদের গোয়ালটা একটু পরিষ্কার করে দিলে ওরা কিছু টাকা দেবে আশিসের মাকে। তবে আগে স্কুলে গিয়ে রেজাল্ট জানতে হবে। মা ফিরলে বাবা-মা আর ও একসঙ্গে খেতে বসবে। পান্তাভাত আর পোস্তবাটা। রোজ দু’বেলা খাবার জোটে এমনটা তো নয়। তবে আজকের ইঞ্জেকশনটা নিজে নিয়ে নিয়েছে। গায়ে একটু জোর পেলেই স্কুলে যাবে ও।
বুধবার আবার কলকাতা যাওয়া। কলেজের খোঁজে? না, ঠিক তা নয়। গত দশ বছর ধরে নিয়মিত প্রায় ১৮ হাজার টাকার ইঞ্জেকশন নিতে হয় আশিস কারককে। দিনে দুটো ‘ফ্যাক্টর ৮’ ইঞ্জেকশন। এক একটার দাম ৯ হাজার টাকা। কারণ, ডাক্তারি পরিভাষায় ‘সিভিয়ার হিমোফিলিয়া’-তে আক্রান্ত আশিস। বয়স ১৮। বাঁকুড়ার ইন্দাসের প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দা আশিস এ বার উচ্চমাধ্যমিকে ৭০.৬ শতাংশ নম্বর পেয়েছে। লেটার পেয়েছে দর্শন ও সংস্কৃতে। রাজখামার হাইস্কুলের এই ছাত্রের জন্য গর্বিত শিক্ষকরাও।
এক দিকে চরম দারিদ্র্য, অন্য দিকে মারণ অসুখ। সব কিছুকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে জয়ী হয়েছে আশিস। মার্কশিট হাতে পেয়ে কেমন লাগছে জানতে চাইলে প্রথমেই ও বলে, ‘‘কী নিয়ে পড়লে তাড়াতাড়ি চাকরি পাব বলো তো। তাই পড়ব। মা রোজ অন্যের বাড়িতে কাজ করে। বাবা শয্যাশায়ী। আমার অসুখ। সারা ক্ষণ গা-হাত-পা ব্যথা করে। হাঁটতে গেলেই লাগে। এ দিকে টাকার খুব দরকার। পড়ার তো খরচ রয়েছে। আমায় জিততেই হবে।’’
আরও খবর:
ফার্স্ট বয়ের দিনে পড়াশোনা, রাত জেগে নাটকের মহড়া আর গান
মাধ্যমিকে প্রথম দশে না থাকার মনখারাপটা আজ থেকে উধাও সেকেন্ড বয়ের
‘মা পাশে না থাকলে অঙ্ক মিলত না’
প্রথম কবে হিমোফিলিয়া ধরা পড়ে জানতে চাইলে আশিসের মা বলেন, ‘‘ছোটবেলায় খেলার সময় ওর বুকে খুব ব্যথা করত। এক দিন আচমকা পা কেটে গেল। রক্তই আর বন্ধ হয় না। তার পর গ্রামের ডাক্তারবাবুকে দেখালাম, তিনিও বুঝতে পারলেন না। কলকাতায় যেতে ধরা পড়ল, ‘হিমোফিলিয়া এ’ নামে একটা রক্তের অসুখ। এই অসুখে নাকি রোজ ইঞ্জেকশন নিতে হয়। তার পর শুরু আমার মুনিষ খাটা, লোকের বাড়ি গিয়ে মুড়ি ভাজা, ধান সেদ্ধ করা। ইঞ্জেকশনগুলোর যে অনেক দাম। কী করব, ছেলে যে মন দিয়ে পড়াশোনাটা করতে চায়!’’ আশিসের চিকিৎসার খরচ বাবদ কয়েকটি সংগঠনও মাঝেমধ্যে আর্থিক সাহায্য করে। এ ছাড়াও আছেন ওর ‘সুদীপ্তকাকু’। হাসপাতালের পথেই তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল আশিসের। তিনি ওদের নিয়মিত অর্থ সাহায্য করেন। দুর্গাপুরের হিমোফিলিয়া সোসাইটির তরফে অজয় রায় বলেন, প্রথম থেকেই বিনামূল্যে আশিসের চিকিৎসা চলছে। অনেক সময় যাতায়াতের ভাড়াও দেওয়া হয়েছে সোসাইটির তরফে। বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ থেকেও আশিসের পরিবারকে সাহায্য করা হয়েছে। ভবিষ্যতেও আশিসের পাশে থাকার আশ্বাস দেন অজয়বাবু।
প্রতি সপ্তাহে দুর্গাপুর গিয়ে আশিসদের ইঞ্জেকশন কিনে আনতে হয়। চিকিৎসার জন্য যেতে হয় কলকাতাও। দু’বেলা ঠিকমতো খাওয়ার জোগান নেই। এ দিকে এ রকম খরচ শুধু ইঞ্জেকশনেই। কলকাতার ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের হিমাটোলজির বিভাগীয় প্রধান প্রান্তর চক্রবর্তী বললেন, ‘‘মারণ রোগ বলে ছেলেটাকে দমিয়ে দেওয়ার কোনও মানে নেই। সবাইকে পাশে এসে দাঁড়াতে হবে। আশিসের যা রোগ, তাতে নিয়মিত ‘ফ্যাক্টর ৮’ ইঞ্জেকশন ওকে নিতেই হবে।’’
প্রান্তরবাবু জানান, আশিসের মতো ‘পার্সন উইথ হিমোফিলিয়া’ রোগীর ক্ষেত্রে গড় আয়ু স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে খানিকটা কম তো বটেই। কারণ হাত-পা কেটে গেলে রক্ত জমাট না বাঁধার সমস্যা তো রয়েইছে। এ ছাড়াও কনুই, কোমরের সন্ধি, ফেটে গিয়ে আচমকাই হাত-পা ফুলে গিয়ে তা ফেটে রক্তও বেরোতে পারে। তাই ফ্যাক্টর ৮ ইঞ্জেকশন জরুরি। মানুষের রক্তরস, অর্থাৎ প্লাজমায় ‘ফ্যাক্টর ৮’ উপাদানটি তৈরি না হওয়ায় আশিসের এই রোগ। নিয়মিত চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারলে আশিস জয়ী হবেই।
সামনের সপ্তাহেই কলকাতায় আসবে আশিস। সরকারি অনুদানের মানেটাও ওর পরিবারের কারও জানা নেই। তবে এ বার কলকাতা গেলে হাসপাতালের পথেই পরিচয় হওয়া সুদীপ্তকাকুর কাছে ও জানতে চাইবে, কোন কলেজে ভর্তি হলে ওর ভাল হবে। কাকুর সঙ্গে দেখা করে প্রণাম করতেই হবে।
চরম দারিদ্র আর মারণ রোগের হার্ডল পেরনোর দৌড় শুরু করেছে আশিস। বাঁকুড়ার ইন্দাস থেকে দৌড়ের শুরু তাঁর। সামনে স্বপ্নে মোড়া তেপান্তরের মাঠ!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy