অপর্ণা ঘোষ, বলাগড়ে আক্রান্ত স্কুল শিক্ষিকা
গাড়ির ভিতরে বৃদ্ধা মাকে নিয়ে সিঁটিয়ে বসে রয়েছি। চারপাশে ঘিরে থাকা ছেলেগুলি উন্মত্তের মতো গাড়ি ভেঙে চলেছে। মায়ের মাথা ফেটে রক্ত ঝরছে। তবুও ওদের কোনও হুঁশ নেই!
গাড়ির উইন্ডস্ক্রিন, জানলার কাচ ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছে। সেই ফাঁক দিয়েই ঢুকে এল কতগুলি মহিলার হাত। মারধরের পর এ বার লক্ষ্য আমার শাড়ি, সোয়েটার! আগেই হাতজোড় করে বলেছিলাম, আমরা ছেলেধরা নই। আমি স্কুলে পড়াই। এ বার ফের কাকুতি-মিনতি করে বললাম, আমার জামাকাপড় ছিঁড়ো না।
আগের বার ছেলেগুলি কথায় কান দেয়নি। এ বার মহিলারাও দিল না! যে যেমন পারল মারল। শাড়ি, সোয়েটার টেনে ছিঁড়ে দিল! তখন রীতিমতো ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছি, আর সময় গুনছি। ওদের মারে আমার গাড়ির চালক বিশ্বনাথেরও বেহাল অবস্থা।
ছোটবেলার বন্ধু সপ্তর্ষি অনেক দিন ধরেই ওর বলাগড়ের বাড়িতে যেতে বলছিল। শনিবার স্কুল হাফ-ছুটি হয়ে যেতেই মাকে ফোন করেছিলাম। মা রাজি হতেই কল্যাণীর বাড়ি থেকে মাকে নিয়ে ঈশ্বরগুপ্ত সেতু পার হয়ে বলাগড়ের রাস্তা ধরি। রাস্তা ফাঁকাই ছিল। শীতের পড়ন্ত বিকেল, আবহাওয়াও মনোরম। বলাগড়ের একটু আগেই রাস্তার ধারে গাড়ি দাঁড় করাই। এক মহিলাকে ডেকে সপ্তর্ষির বাড়ির ঠিকানা বলে কোন দিক দিয়ে যাব, জানতে চেয়েছিলাম। উনি হাসিমুখেই বলেছিলেন, ‘‘ওই দিকে যান। একটা আমবাগান পাবেন। ওখানে লোককে বললেই দেখিয়ে দেবে।’’
সেই মতো আমবাগানে ঢুকতেই হঠাৎ কোথা থেকে যেন তিন-চারটে বছর বাইশ-চব্বিশের ছেলে এসে গাড়ি ঘিরে ধরল। তখনও বিপদ বুঝিনি। গাড়ির কাচ নামাতেই ওদের এক জন বলে উঠল, ‘‘বাচ্চাটা কোথায়?’’ আমি তখনও বুঝিনি। বললাম, ‘‘ভাই, বাচ্চা তো কেউ নেই। আমি আগরপাড়ার একটা স্কুলে পড়াই। মাকে নিয়ে বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছি।’’ সপ্তর্ষির ঠিকানা লেখা কাগজটাও দেখালাম। কিন্তু তাতে মন গলল না। উল্টে কাগজটা কেড়ে নিয়ে ফেলে দিল। বলল, ‘‘ও সব বলে লাভ নেই। আমাদের কাছে খবর আছে, এই গাড়িতেই একটা বাচ্চাকে চুরি করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।’’
ওরা যে কী বলছিল, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। দেখলাম, পিলপিল করে জড়ো হচ্ছে আরও কিছু পুরুষ এবং মহিলা। ব্যস, লাঠি, বাঁশ, ইট নিয়ে সবাই মিলে চড়াও হল আমার গাড়ির উপরে। বিপদ বুঝে গাড়ির সব দরজা ‘লক’ করে দিলাম। চোখের সামনেই ঝরঝর করে ভেঙে পড়ল উইন্ডস্ক্রিন।
ভাঙচুর চলছে আর তার মধ্যেই আমি ব্যাগ থেকে মোবাইল ফোন বের করে দাদাকে ফোন করি। সব কিছু বলতে পারিনি। শুধু বলেছিলাম, ‘‘আমাদের বাঁচা!’’ ফোন করছি দেখে যেন আরও ক্ষেপে গেল ওরা। এক জন মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে বলল, ‘‘নিজেদের এলাকায় ফোন করছিস? করাচ্ছি ফোন!’’
কত ক্ষণ এ ভাবে চলেছিল মনে নেই। হঠাৎ তিনটি ছেলে এসে উদয় হল। ওরা হামলাকারীদের বলছিল, ‘‘ওদের মারিস না। ওরা খারাপ লোক মনে হয় না। তোরা ভুল করছিস।’’ কিন্তু হামলা পুরো থামল না। তার মধ্যেই দেখলাম, তিন-চার জন পুলিশও এসেছে। পুলিশ দেখতেই কিছু লোক পালাল। বন্ধ হল মারধর। পুলিশ আর ওই তিন-চারটি ছেলে মিলেই আমাদের গাড়িতে চাপিয়ে হাসপাতালে নিয়ে গেল। যেতে যেতে শুনলাম, দাদার পরিচিত এক পুলিশ অফিসারকে বলতে তিনিই উদ্ধারের ব্যবস্থা করেছেন। মোবাইলের টাওয়ার লোকেশন দেখে আমরা কোথায় রয়েছি, তা-ও বের করেছে পুলিশ।
হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরে চিকিৎসা হল। তার পর রাতে দাদা নিয়ে এল কল্যাণীর হাসপাতালে। কিন্তু শনিবার বিকেলের ওই স্মৃতি যেন পিছু ছাড়ছে না।
পুলিশ দেরিতে পৌঁছলে ওরা বোধ হয় আমাদের মেরেই ফেলত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy