স্বীকৃতি: পুরস্কার হাতে তাপসী মণ্ডল।
রোগাসোগা গড়ন। আপাত ধীরস্থির। কিন্তু বেচাল দেখলে এই মেয়েই ‘বাঘিনী’। নাবালিকার বিয়ে, শ্বশুরবাড়িতে বধূর উপরে অত্যাচার, কিশোরী কন্যাকে স্কুল ছাড়িয়ে দিতে চাইছেন বাড়ির লোক— এমন খবর কানে এলে তিনি বসে থাকতে পারেন না। গত কয়েক বছরে এমন ঘটনার শিকার মেয়েদের নিয়ে লড়াই চলছে সুন্দরবনের প্রত্যন্ত বালিদ্বীপের বাসিন্দা তাপসী মণ্ডলের।
সদ্য চল্লিশ পেরনো এই মহিলাকে তাঁর কাজের স্বীকৃতি দিল হুগলির শ্রীরামপুরের শ্রমজীবী হাসপাতাল। রবিবার হাসপাতাল ভবনে এক অনুষ্ঠানে অনন্য মানবিক কাজের জন্য ‘সুদক্ষিণা লাহা স্মৃতি পুরস্কার’ তুলে দেওয়া হল তাঁর হাতে। ‘শর্মিলা ঘোষ সাহিত্য পুরস্কার’ পেয়েছেন অরুন্ধতী ভট্টাচার্য।
গদখালি থেকে খেয়া পেরিয়ে বালিদ্বীপ। আঠেরো বছরের নিচে মেয়েদের বিয়ে হওয়াই ছিল দস্তুর। ষোলো বছরের তাপসী যখন একাদশ শ্রেণিতে পা রেখেছেন, তখন তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। ওই মেয়েবেলাতেই বিয়ে না করে শিক্ষিত হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ইচ্ছে ছিল তাঁর। কিন্তু তা হালে পানি পায়নি। শ্বশুরবাড়িতেও সেই ইচ্ছা সকলের হাসিতে গড়াগড়ি খেয়েছিল। সেখানে ভোর থেকে খাটতে হত। উনিশ বছরেই তিনি দুই
মেয়ের মা।
তাপসী জানান, তখন হতাশ হয়ে পড়েছিলেন তিনি। তার পরেই জীবনের মোড় ঘোরে। স্বামী-সন্তানদের নিয়ে অন্যত্র থাকতে শুরু করেন। স্বামী তেমন কাজ করতেন না। স্টেশনারি দোকান দিয়ে রোজগারের ব্যবস্থা করেন তাপসীই। গ্রামের স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের নাচ শেখানোর দায়িত্ব দেন তাঁকে। অসহায়দের মেয়েদের পাশে দাঁড়াতে এলাকার সমাজ-সচেতন মানুষ ‘বিজয়নগর দিশা’ নামে একটি সংগঠন তৈরি করেন। বছর দশেক আগে তাপসী তার সঙ্গে যুক্ত হন। বাল্যবিবাহ আটকানো, গার্হস্থ্য হিংসার শিকার মেয়েদের সমাজের মূলস্রোতে ফেরানোর কাজে লাগেন। এ নিয়ে প্রশিক্ষণও নেন।
ওই সংগঠনের তৎপরতায় কয়েক বছরে বেশ কিছু নাবালিকার বিয়ে বন্ধ হয়েছে। নির্যাতিতা বধূ ভরসা পেয়ে লড়াইয়ের পথ বেছে নিয়েছেন। কয়েকশো মেয়ের কাউন্সেলিং করা হয়েছে। বিয়ে ঠিক হয়ে যে মেয়ের পড়া বন্ধ হতে বসেছিল, তিনি স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে এমএ-তে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছেন। মদ্যপ স্বামীর হাতে মার খেতে যাতে না হয়, সে জন্য সবাই মিলে মদের ভাঁটি গুড়িয়ে দিয়েছেন। তাপসী এখন ‘দিশা’র সম্পাদক।
তিনি বলেন, ‘‘শুরুতে নাবালিকার বিয়ে বন্ধ করতে গিয়ে ঘাড়ধাক্কা খেতে হয়েছে। এখন পুরোহিতরাও মেয়ের জন্ম-শংসাপত্র দেখতে চান। ছাত্রছাত্রী থেকে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ আমাদের পাশে রয়েছেন। মেয়েদের স্বনির্ভর করতে লড়াই চলবে।’’ তাপসী জানান, স্বামীকে সব কাজে পাশে পেয়েছেন। জীবনের লড়াইয়ের কথা বলতে গিয়ে চোখ চিকচিক করে ওঠে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলে কুর্নিশ করেন তাঁর লড়াইকে।
তাপসীর বড় মেয়ে প্রীতিকণা স্নাতক হয়েছেন। ছোট মেয়ে স্মৃতিকণা বিএসসি প্রথম বর্ষের ছাত্রী। তাপসী জানিয়ে দেন, ‘‘মেয়েরা নিজের পায়ে দাঁড়াক।’’ উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাপসী নিজেও। সে জন্য মুক্ত বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন।
মেয়েবেলার ভাঙা স্বপ্ন জোড়া লাগাতে চোয়াল শক্ত করে তিনি লড়ছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy