Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

প্রতিষ্ঠিত করা হোক নৈঃশব্দ্যের অধিকার

বেশ কয়েক বছর আগে কালীপুজোর রাতে দিল্লিতে একটি মেয়ের উপরে কিছু দুষ্কৃতী অত্যাচার চালাতে সচেষ্ট হয়। সাহায্যের আশায় মেয়েটি চিৎকার করে।

এই দৃশ্য প্রায়ই দেখা যায়।—ফাইল চিত্র।

এই দৃশ্য প্রায়ই দেখা যায়।—ফাইল চিত্র।

বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় (পরিবেশবিদ)
শেষ আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০১৯ ০০:০৭
Share: Save:

শব্দের সুচারু প্রয়োগ জরুরি। কিন্তু শব্দবাজির নয়। অবাঞ্ছিত শব্দের নয়। কিন্তু সেই অবাঞ্ছিত শব্দের ব্যবহারেই তৈরি হয়ে গিয়েছে ‘শব্দদানব’। আর তার অত্যাচারে ঘটে যাচ্ছে নানা ঘটনা।

বেশ কয়েক বছর আগে কালীপুজোর রাতে দিল্লিতে একটি মেয়ের উপরে কিছু দুষ্কৃতী অত্যাচার চালাতে সচেষ্ট হয়। সাহায্যের আশায় মেয়েটি চিৎকার করে। প্রতিবেশীদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে। কিন্তু কালীপুজোর রাতে প্রচণ্ড শব্দবাজির কারণেই কেউ তাঁর চিৎকার শুনতে পাননি। দুষ্কৃতীরা অবাধে মেয়েটির উপরে অত্যাচার চালায়। পরের দিন মেয়েটি আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।

১৯৯৭ সালে শ্রীরামপুরের পিয়ারাপুর এলাকায় কিছু সমাজবিরোধী কালীপুজোর রাতে শব্দবাজির তাণ্ডব শুরু করে। অবস্থা ক্রমশ অসহনীয় হয়ে ওঠায় স্থানীয় যুবক দীপক দাস প্রতিবাদ করেন। কিছুক্ষণের জন্য সমাজবিরোধীরা পিছু হটে। পরের দিন সকালে দুষ্কৃতীরা দলবদ্ধ ভাবে যুবকটিকে আক্রমণ করে এবং তাঁকে হত্যা করে। দীর্ঘ বিচারের পরে উপযুক্ত সাক্ষ্যের অভাবে আসামিরা নির্দোষ বলে ঘোষিত হয়। এ রাজ্যের প্রথম ‘শব্দ-শহিদের’ বাবা-মায়ের সামনেই তাঁদের সন্তানের হত্যাকারীরা আজও অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একই ভাবে পশ্চিমবঙ্গের বুকে শব্দের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে আরও অনেকের মৃত্যু হয়েছে।

কিন্তু এই ‘শব্দদানবের’ হাত থেকে বাঁচার তাগিদেই নানা আইন তৈরি হয়েছে। আইনের সুচারু প্রয়োগের পথ প্রশস্ত হয়েছে ১৯৯৬-এর এপ্রিলে বিচারপতি ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক ঐতিহাসিক রায়ে। ঘোষিত হল, কোনও মানুষ কোনও মানুষকে বন্দি বা দাস শ্রোতাতে পরিণত করতে পারবেন না। মত প্রকাশের স্বাধীনতা গণতন্ত্রের স্বার্থে আবশ্যিক, সভ্যতার অগ্রগতির প্রয়োজনেও। ঠিক তেমনই কোনও কিছু শুনতে না-চাওয়াও জীবনের পক্ষে অপরিহার্য। মানবজীবনে শব্দের প্রয়োজন যেমন আবশ্যিক, ঠিক তেমনই নৈঃশব্দও জীবনের অপরিহার্য সঙ্গী। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ এই ঐতিহাসিক রায়কে গ্রহণ করেছেন। তাঁরা হয়ে উঠেছেন শব্দদূষণের বিরুদ্ধে সচেতন। বাস্তবিকই এই রায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। বিচারপতির এই রায় সাধারণ মানুষের কল্যাণার্থে। তাই একে কার্যকর করা আজ অত্যন্ত জরুরি। সমাজের সকল স্তরের মানুষের দৃঢ় মানসিকতা আগামীদিনে এই রায়কে কার্যকর করতে সাহায্য করবে।

শব্দদূষণের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ন্যায়ালয়ের একের পর এক রায় কেন্দ্রীয় সরকারকে বিষয়টি নতুন ভাবে চিন্তা করতে বাধ্য করে। তার ফলস্বরূপ ২০০০ সালে প্রণয়ন করা হয় শব্দদূষণ সংক্রান্ত নতুন আইন। যার প্রধান উদ্দেশ্য শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ। মানুষের অদূরদর্শী ক্রিয়াকলাপই শব্দদূষণের প্রধান কারণ। নগরায়ণ, শিল্পের প্রসার, প্রযুক্তির প্রগতি, পরিবহণের প্রসার এবং মানুষের জীবন প্রণালীতে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনই সুরবর্জিত শব্দদূষণের কারণ। সেই দূষণ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।

দুর্গাপুজো শেষ হয়েছে। আজ, কালীপুজো। উৎসবের রেশ থাকবে সরস্বতী পুজো পর্যন্ত। জোরে মাইক বাজবে, নিয়ম ভেঙে শব্দবাজির ব্যবহার হবে। তবু চেষ্টা করতেই হবে, নৈঃশব্দ্যের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে। ‘শব্দদানব’ এক সময় পশ্চিমবঙ্গে বোতলবন্দি হয়েছিল। কিন্তু সে আবার বোতলের বাইরে বেরিয়ে এসেছে। বহু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘শব্দদানব’কে বোতলবন্দি করতে নাগরিক আন্দোলন শুরু করেছে। প্রশাসনকে সক্রিয় হতে আবেদন করছে। ‘শব্দদানব’ যদি বোতলবন্দি না হয়, তবে আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে আরও অনেক ‘শব্দ শহিদের’ জন্য। পশ্চিমবঙ্গে ১৯৯৭ সাল থেকে আজ পর্যন্ত ১২ জন ‘শব্দ শহিদ’ হয়েছেন। যদিও একটি ছাড়া আর কোনও ক্ষেত্রেই দোষীরা শাস্তি পায়নি। দোষীদের দ্রুত শাস্তি ও ‘শব্দ-শহিদ’দের পরিবারের ক্ষতিপূরণের জন্য হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা বিচারাধীন।

অন্য বিষয়গুলি:

Sound Pollution Kali Puja 2019
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy