ভয়াবহ: নির্মীয়মাণ বহুতলের এই অংশই ভেঙে পড়েছে। সোমবার, সালকিয়ায়। নিজস্ব চিত্র
সময় যত গড়াচ্ছে, ধসে পড়া বাড়ির ফাটলও ততই বাড়ছে। ক্রমেই আরও বেশি হেলে পড়ছে তাঁদের বাড়ির উপরে। আতঙ্কে রাতে ঘুমোতে পারছেন না। খিদে-তেষ্টাও কমে গিয়েছে। পুরসভা নোটিস দিয়ে বলেছে, ১৫ দিনের জন্য বাড়ি ফাঁকা করে অন্যত্র চলে যেতে। তা সত্ত্বেও বাড়ি থেকে এক পা-ও নড়তে রাজি নন হাওড়ার সালকিয়া এলাকার ত্রিপুরা রায় লেনের বাসিন্দা, ষাটোর্ধ্ব মণ্ডল দম্পতি। তাঁদের বাড়ির পাশেই দিন দুই আগে ভেঙে পড়েছে একটি নির্মীয়মাণ বেআইনি বাড়ি। সেই বাড়ির বাকি অংশও যদি ভেঙে পড়ে তাঁদের বাড়ির উপরে? এই আতঙ্ক নিয়েই তাঁরা রয়ে গিয়েছেন নিজেদের বাড়িতে। বলছেন, ‘‘আমরা বাড়ি ছেড়ে যাব কোথায়? আমাদের বলা হয়েছিল, পাড়ার ক্লাবে থাকতে। কিন্তু আমরা কি এই বয়সে ক্লাবে গিয়ে থাকতে পারি? আর নিজেদের বাড়ি থাকতে ক্লাবে শুতে যাব কেন?’’
শনিবার গভীর রাতে সালকিয়ার ত্রিপুরা রায় লেনে বছরখানেক ধরে কাজ চলা একটি নির্মীয়মাণ পাঁচতলা ফ্ল্যাটবাড়ি আচমকাই ভেঙে পড়ে। মাটির ভিতরে বসে যায় গোটা একতলা। পুরো বাড়িটি বিপজ্জনক ভাবে হেলে পড়ে পাশের একটি বাড়ির উপরে। আশপাশের আরও দু’টি বাড়িও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ওই ঘটনার পরে আতঙ্কে তিনটি বাড়ির বাসিন্দারাই বাড়ির বাইরে রাত কাটান। রবিবার হাওড়া পুরসভার পক্ষ থেকে ওই তিনটি বাড়ির মালিকদের ১৫ দিনের জন্য বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার নোটিস দেওয়া হয়। এলাকার বাসিন্দাদের অবশ্য অভিযোগ, পুরসভা বাড়ি খালি করার নোটিস দিয়েই দায় সেরেছে। ঘটনার পরে ৪৮ ঘণ্টা কেটে গেলেও বাড়িটি ভেঙে ফেলার কাজ শুরু হয়নি।
পুরসভা যে উদ্যোগী হয়নি, তা ঘটনাস্থলে গিয়েই বোঝা যায়। তিনটি পরিবারকে সরে যাওয়ার নোটিস দিলেও একটি পরিবার ছাড়া বাকিরা নিজেদের বাড়িতেই রয়েছেন। সকলেরই প্রশ্ন, পুরসভা ওই বাড়ি কবে ভাঙবে? আর ভাঙতে গেলে পাশের বাড়িগুলির কোনও ক্ষতি হবে না তো?
আতঙ্কের কথা শোনাচ্ছেন পাশের বাড়ির মণ্ডল দম্পতি। সোমবার, সালকিয়ায়। নিজস্ব চিত্র
বাড়িটি যে দিকে হেলে রয়েছে, সেই দিকে থাকেন বিএসএনএল-এর অবসরপ্রাপ্ত কর্মী প্রকাশ মণ্ডল ও তাঁর স্ত্রী শঙ্করী মণ্ডল। ছেলে বিদেশে চাকরি করেন। মেয়ে বিয়ের পর থেকে কলকাতায় থাকেন। খবর পেয়ে মেয়ে-জামাই অবশ্য রবিবারই ছুটে এসেছিলেন। নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন বাবা-মাকে। পুরসভার নোটিস পেলেও বাড়ি ছেড়ে যেতে চাননি বৃদ্ধ দম্পতি। তবে অঘটন যে ঘটতে পারে, তা ধরে নিয়েই নিজেদের মতো করে প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাঁরা। সকালেই মিস্ত্রি ডেকে হেলে পড়া বাড়ির দিকে লাগানো দু’টি এসি খুলে ঘরের ভিতরে রেখেছেন। শোয়ার ঘরের বদলে রাতে অন্য ঘরে শুচ্ছেন। সোমবার প্রকাশবাবু তাঁর বাড়িতে বসে বলেন, ‘‘বাড়ি ফাঁকা রেখে গেলে চোরের ভয়। এত জিনিসপত্র ছেড়ে তাই যাইনি। তবে ওই রাতের আতঙ্ক আমাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে। আমাদের গোটা বাড়িটা থরথর করে কাঁপছিল।’’
সদ্য ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছে প্রকাশবাবুর স্ত্রী শঙ্করীদেবীর। তিনি বলেন, ‘‘আমরা মাঝে মাঝেই ছাদে উঠে গিয়ে দেখছি, বাড়িটা আর কতটা হেলে পড়ল। ফাটল কতটা বাড়ল। আমার তো ভয়ে ঘুম, খিদে, তেষ্টা— সব উবে গিয়েছে।’’
অন্যত্র যেতে রাজি নন ভেঙে পড়া বহুতলের পাশের আর একটি বাড়ির বাসিন্দা সুজিত দাসও। তিনি বলেন, ‘‘বাড়িঘর ছেড়ে যাব কোথায়? ছেলের পড়াশোনা আছে। তবে রাতটা বন্ধুবান্ধবের বাড়িতে কাটাচ্ছি। কিন্তু এ ভাবে ক’দিন চলবে?’’
হেলে পড়া বাড়িটি পুরোপুরি ভেঙে পড়লে তাঁর বাড়ির যে মারাত্মক ক্ষতি হবে, তা মানছেন সুজিতবাবু। তাঁর কথায়, ‘‘ওই বাড়িটা পাশের বাড়ির কার্নিস থেকে কাল অন্তত এক ফুট দূরে হেলে ছিল। আজ কার্নিসে ঠেকে গিয়েছে। তাই বোঝা যাচ্ছে বাড়িটা ক্রমশ হেলছে। পুরসভা অবিলম্বে ব্যবস্থা না নিলে ভয়ানক ঘটনা ঘটে যাবে।’’ দাস পরিবারের আশঙ্কা, ঝড়বৃষ্টি হলে বাড়িটা ধসে পড়বেই। তখন কারও বাঁচার রাস্তা থাকবে না।
উত্তর হাওড়ার তৃণমূল সভাপতি তথা ১১ নম্বর ওয়ার্ডের প্রাক্তন কাউন্সিলর গৌতম চৌধুরী বলেন, ‘‘ওই বাড়িটি শীঘ্রই ভেঙে ফেলা হবে। সেই কাজে প্রায় ১৮ লক্ষ টাকা লাগবে। ওই খরচ বাড়ির প্রোমোটারদের থেকে আদায় করব। তবে এই কাজ করতে সময় লাগবে। তাই যে পরিবারগুলি অন্যত্র থাকতে চাইছে, তাদের ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে।’
হাওড়ার পুর কমিশনার বিজিন কৃষ্ণ বলেন, ‘‘ওই বাড়িটি বিশেষজ্ঞ সংস্থাকে দিয়ে ভাঙতে হবে, না হলে আশপাশের বাড়িগুলির ক্ষতি হবে। তাই আমরা কলকাতা পুরসভার ‘ডেমোলিশন স্কোয়াড’-এর সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। দু’তিন দিনের মধ্যে কাজ শুরু হয়ে যাবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy