বহুতলে ঢাকছে শহর।
বাড়ির রোয়াকে বসে আড্ডা, বিকেলে বল নিয়ে মাঠে দাপাদাপির জগৎটা প্রায় অতীত। যৌথ পরিবার ভেঙে ক্রমশ নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি হয়ে যাওয়া নবীন প্রজন্মের দু’মহলা বাড়ির চেয়ে দু’-তিন কামরার ফ্ল্যাটের উপরেই ঝোঁক বেশি। যা আর পাঁচটা শহরের মতো দ্রুত বদলে দিচ্ছে এই জনপদকেও। প্রমোটারদের দাপটে একের পর এক মাথা তুলছে বহুতল। কিন্তু আধুনিক আবাসনের হাত ধরে শহর ক্রমশ আধুনিক হতে চললেও তার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেনি পরিষেবার উন্নতি। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। উন্নত নিকাশি, আর প্রয়োজনীর রাস্তার অভাবে নাকাল জনপদের মানুষজন। যার অনেকটাই আঁচ মিলেছে সম্প্রতি কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে।
পুরনো নথি থেকে জানা যায়, ডোমজুড় থানা তৈরি হয়েছিল ১৮৫৩ সালে। তারও কয়েকশো বছর আগে থেকে এই জনপদে লোকবসতি শুরু হয়েছিল। বর্তমানে শহরের উপর দিয়ে যাওয়া হাওড়া-আমতা রোড এবং ৬ নম্বর জাতীয় সড়ক হুগলি ও পূর্ব মেদিনীপুর জেলার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছে। রাজ্য সরকারের প্রধান কার্যালয় নবান্ন থেকে এর দূরত্ব বড়জোর ৩০ মিনিট। অলঙ্কার শিল্পের জন্য পরিচিত এই শহরে প্রতিদিনই বাইরে থেকে প্রচুর মানুষ আসেন। উন্নত নাগরিক পরিষেবা দিতে ডোমজুড় পুরসভা তৈরির প্রাথমিক প্রক্রিয়াও শুরু হওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়েই বাড়ছে জমির দাম। তৈরি হচ্ছে বহুতল। পাশপাশি জলা জমি বুজিয়ে বেআইনি নির্মাণের অভিযোগও উঠছে। ফলে গোটা ডোমজুড়েই জল নিকাশি একটা বড়সড় সমস্যার আকার নিয়েছে।
বেহাল নিকাশির পরিণাম।
সম্প্রতি টানা বৃষ্টিতে হাওড়া-আমতারোড চলে গিয়েছিল জলের তলায়। সাম্প্রতিক অতীতে যা কখনও হয়নি বলেই দাবি করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। জল সরার জায়গা না পাওয়ায় ডোমজুড় সংলগ্ন রাজাপুর, রুদ্রপুর, পার্বতীপুর এলাকার অধিকাংশ জায়গায় এখনও জমে রয়েছে জল। স্থানীয় বাসিন্দা সোমনাথ চক্রবর্তীর অভিযোগ, ‘‘আগে বৃষ্টি হলে পুকুর, জলাজমিতে জল নেমে যেত। এখন বহুতল তৈরির চাপে জলাজমি প্রায় অদৃশ্য। ফলে একের এক আবাসন তৈরি হয়ে গেলেও জল নিকাশির উপায় নেই। এ বারের বর্ষায় তাই নাজেহাল হতে হয়েছে।’’ মাস কয়েক আগে পুকুর ভরাট ও বেআইনি নির্মাণের অভিযোগে মহিয়াড়িতে পথ অবরোধ ও মিছিল হয়েছে। কয়েকটি ক্ষেত্রে লিখিত অভিযোগও হয়েছে ডোমজুড় থানা ও ব্লক অফিসে।
বহুতল নির্মাণ প্রকল্পের এক কর্তার দাবি, সব জায়গা থেকে প্রয়োজনীয় অনুমতি নিয়েই তারা আবাসন তৈরির কাজে হাত দিয়েছেন। জল নিকাশির সমস্যা মেটাতে মাটির নীচে নিকাশি ব্যবস্থা তৈরির চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। সাহিত্যিক তথা ডোমজুড়ের বাসিন্দা উল্লাস মল্লিক বলেন, ‘‘ব্যক্তিগত কারণে ডোমজুড়ে কিছু আবাসন দেখতে গিয়েছিলাম। বেশিরভাগ জায়গাতেই জল বের করার ব্যবস্থা চোখে পড়েনি।’’ স্থানীয় একটি পত্রিকার সম্পাদক সমীর দাসের দাবি, ‘‘মাকড়দহের জলা হল সরস্বতী নদীর অববাহিকা অঞ্চল। সেটিকে বুজিয়ে নির্মাণ কাজ হওয়ার জল বেরোতে পারছে না।’
ডোমজুড়ের বিডিও তমোঘ্ন কর বলেন, ‘‘সম্প্রতি রাজাপুর খাল সংস্কারে অর্থ বরাদ্দ হয়েছে। তবে তাতে পুরো ডোমজুড় ব্লকের নিকাশি সমস্যা মিটবে না। এ জন্য আলাদা করে মাস্টার প্ল্যান তৈরির প্রয়োজন। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করব।’’’
বহুতল নির্মাণ নিয়ে নানা অভিযোগ থাকলেও শহরে জমির দাম বাড়ছে হু হু করে। এলাকার জমি কেনাবেচার সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, হাওড়া-আমতা রোডের ধারে বর্তমানে জমির দাম প্রায় ১২-১৫ লক্ষ টাকা প্রতি কাঠা। কোনও কোনও ক্ষেত্রে কাঠা প্রতি ২০ লক্ষ টাকা অবধি দর উঠছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জমি ব্যবসায়ী বলছেন, ‘‘বছর পাঁচেক আগেও হাওড়া-আমতা রোডের ধারে ৬-৭ লক্ষ কাঠা দরে জমি পাওয়া যেত। এখন ডোমজুড়ের ভিতর দিকেও ওই দামে ভাল জমি মেলা ভার।’’
ডোমজুড় পঞ্চায়েত সমিতির বন ও ভূমি কর্মাধ্যক্ষ সজল ঘোষ (বীরু) মানছেন, এখন জমির দাম নির্ভর করে ক্রেতা ও বিক্রেতার উপর। অনেকেই নিয়মবিরুদ্ধ ভাবে জমি কিনছেন। তবে সে ক্ষেত্রে উপযুক্ত নথির অভাবে তাঁদের ‘মিউটেশন’ আটকে যাচ্ছে। শহরে বেআইনি নির্মাণের অভিযোগ মেনে নিয়েছেন পঞ্চায়েত সমিতির পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ সুবীর চট্টোপাধ্যায় (টিঙ্কাই)। তাঁর দাবি, বহুতল নির্মাণের বিষয়টি মূলত স্থানীয় পঞ্চায়েত ও জেলা পরিষদ দেখভাল করে। ব্লক অফিসে বেআইনি নির্মাণ সংক্রান্ত অভিযোগ এলেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সম্প্রতি ডোমজুড় বাজারে নিকাশি নালা বুজিয়ে একটি বহুতল তৈরির বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। পুরো বিষয়টি থানা ও জেলা পরিষদে জানানো হয়েছে।
(চলবে)
ছবি: রমাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy