Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪
বন্ধ কারখানার শ্রমিকদের কাউন্সেলিং মনোবিদের
Chandannagar

দুশ্চিন্তায় দমবন্ধ হয়ে আসে, বলছেন শ্রমিকরা

ঠিক হল, প্রতি সপ্তাহে তিনি কাউন্সেলিংয়ে বসবেন। বুধবার সকালের এই দৃশ্য চন্দননগরের গোন্দলপাড়ার শ্রমিক মহল্লার। পিছনে মস্ত দেওয়ালে ঢাকা গোন্দলপাড়া জুটমিল। যা প্রায় কুড়ি মাস বন্ধ।

পদক্ষেপ: চলছে স্বাস্থ্য শিবির। ছবি: তাপস ঘোষ

পদক্ষেপ: চলছে স্বাস্থ্য শিবির। ছবি: তাপস ঘোষ

প্রকাশ পাল
চন্দননগর শেষ আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০০:১৩
Share: Save:

কয়েকটি বাড়িতে যাওয়ার পরে মনোবিদ জানালেন, এ ভাবে হবে না। কারণ, তাঁর মনে হচ্ছে, অনেকেই হতাশায় ভুগছেন। তাঁদের সঙ্গে আলাদা করে কথা বলতে হবে।

ঠিক হল, প্রতি সপ্তাহে তিনি কাউন্সেলিংয়ে বসবেন। বুধবার সকালের এই দৃশ্য চন্দননগরের গোন্দলপাড়ার শ্রমিক মহল্লার। পিছনে মস্ত দেওয়ালে ঢাকা গোন্দলপাড়া জুটমিল। যা প্রায় কুড়ি মাস বন্ধ।

চন্দননগরের নাগরিক সমাজের উদ্যোগে এক কর্মসূচিতে এখানে এসেছিলেন সৌম্যদীপ কোলে নামে ওই মনোবিদ। উদ্যোক্তাদের দাবি, মিল বন্ধের পরে অবসাদে ভুগে সাত শ্রমিক আত্মঘাতী হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে পাঁচ জন মিলের শ্রমিক। অপর দু’জন অবসর নিলেও প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা মেলেনি। গত ছ’মাসেই চার শ্রমিকের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। এক যুবক সৌম্যদীপকে বলেই ফেললেন, ‘‘যা পরিস্থিতি তাতে আত্মহত্যা ছাড়া উপায় কী!’’ কেউ জানালেন, প্রায়ই মুড়ি খেয়ে রাত কাটছে।

উদ্যোক্তাদের তরফে বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এমনই পরিস্থিতি যে, চাল-ডাল ফোটানোর জন্য গ্যাস কেনার টাকা নেই। কাঠ কুড়িয়ে আনতে হচ্ছে। রোজগার তলানিতে ঠেকায় বাড়িতে অশান্তি হচ্ছে। আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। এই অবস্থায় শ্রমিকদের মানসিক শক্তি বাড়াতে হবে। তাই এই প্রয়াস।’’ সৌম্যজিৎ বলেন, ‘‘অভাবের জেরে পারিবারিক অশান্তি হচ্ছে। তা থেকে মানসিক সমস্যা। ফ্যামিলি-থেরাপি দরকার। স্থায়ী রোজগারের জায়গা তৈরি না হলে অবসাদ বাড়বে। কারও ক্ষেত্রে নেশা করার প্রবণতা বাড়তে পারে।’’

বিশ্বজিৎবাবু জানান, শহরের বড়বাজারে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাঠে প্রতি বৃহস্পতিবার বিকেলে মনোবিদ বসবেন। ওই শ্রমিক মহল্লায় কেউ হতাশায় ভুগছেন, খবর পেলে তাঁর কাছে নিয়ে যাওয়া হবে। আরও কয়েকজন মনোবিদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হচ্ছে। এ দিন এলাকায় পোস্টার সাঁটা হয়— ‘আত্মহত্যা কোনও সমাধান নয়। সংগ্রাম জীবনের অপর নাম’।

একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে এ দিন নিখরচায় স্বাস্থ্য শিবির বসেছিল বিশ্বজিৎবাবুদের উদ্যোগেই। স্কুলটি চালাতেন মিল কর্তৃপক্ষ। শ্রমিক পরিবারের ছেলেমেয়েরা পড়ত। মিলের মতোই স্কুলেও তালা পড়েছে। চিকিৎসক শ্যামাপদ ভট্টাচার্য, অস্থি-বিশেষজ্ঞ অলোক রায়চৌধুরী, স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞ শিপ্রা রায়চৌধুরী মোট ১৬৮ জনের চিকিৎসা করলেন। নিখরচায় ওষুধ দেওয়া হয়। এক জন নার্স, তিন জন স্বাস্থ্যকর্মীও এসেছিলেন। চিকিৎসকেরা জানান, অনেকেই উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবিটিসের সমস্যা নিয়ে এসেছিলেন। রক্তাল্পতা, দূষণজনিত শ্বাসকষ্ট, চর্মরোগেও অনেকে ভুগছেন।

শ্রমিকদের খেদ, মিল বন্ধ হওয়ায় তাঁরা সব দিক থেকেই বিপাকে। দোকানে ধার মিলছে না। কাজের নিশ্চয়তা নেই। অন্য মিলে সপ্তাহে ২-৩ দিন কাজ পেলেও শুধু ‘নাইট ডিউটি’। ফলে, শরীর খারাপ হচ্ছে। কাজের সন্ধানে যাওয়ার জন্য রাহা-খরচও থাকছে না। ইএসআই-এর সুবিধা না-মেলায় যথাযথ চিকিৎসা করা যাচ্ছে না। পরিস্থিতির জেরে বাড়িতে নিত্য অশান্তি।

ধর্মরাজ চৌধুরী নামে এক শ্রমিকের কথায়, ‘‘মিলে মোটামুটি রোজগার হত। এখন মাসে তিন হাজার টাকাও হয় না। দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে। এখন দুই মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে থাকি। ভাত-ডাল-আলুসেদ্ধ বা আনাজ দিয়েই চলছে। কাজ না পেয়ে ফিরলেই বাড়িতে ঝগড়া। মনে হয় যে দিকে দু’চোখ যায়, পালিয়ে যাই। খুব কষ্ট হয়।’’ শত্রুঘ্ন লাল নামে আর এক জনের কথায়, ‘‘দুশ্চিন্তায় দমবন্ধ হয়ে আসে। সংসার চালাতে আত্মীয়-স্বজনের সাহায্য নিতে হচ্ছে।’’ রাতের ঘুম উবে গিয়েছে অজয় সাউয়ের। রক্তচাপ বেড়েছে। চিকিৎসক ওষুধ দিলেন। অজয় এখন ভ্যান নিয়ে ঘুরে ফল বেচেন। দৈনিক ২৫ টাকা ভ্যানভাড়া। তাঁর দুর্ভাবনা, ‘‘আমার তিন ছেলে, এক মেয়ে। মেয়ে, দুই ছেলে পড়ে। মেয়েটা বড় হচ্ছে। কয়েক বছর পরে বিয়ে দিতে হবে। কী করব, ভেবে কিনারা পাই না!’’

এমন মনখারাপ গোন্দলপাড়ার শ্রমিক মহল্লার ঘরে ঘরে।

অন্য বিষয়গুলি:

Chandannagar Gondolpara
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy