Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

ছেলের স্মৃতিতে জনহিতে দান বাবা-মা’র

নেই শুধু সেই ঘরের মালিক। প্রায় এক বছর ধরেই নেই। তিনি এখন শুধুই স্মৃতি!  তবু ঘরটা রোজ ঝাড়পোঁছ করতে ভোলেন না বৈদ্যবাটীর বাদামতলার সুবীর চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী শাশ্বতীদেবী। দম্পতি জানেন, ছেলে আর ফিরবে না। তবু স্মৃতি হারাতে চান না তাঁরা।

অনন্য: দোতলা বাড়ির অংশ মাহেশ শ্রীরামকৃষ্ণ আশ্রমকে দান। শারদোৎসব সমিতিকে দান করা হয়েছে এই বাতানুকূল অ্যাম্বুল্যান্স (ইনসেটে)। নিজস্ব চিত্র

অনন্য: দোতলা বাড়ির অংশ মাহেশ শ্রীরামকৃষ্ণ আশ্রমকে দান। শারদোৎসব সমিতিকে দান করা হয়েছে এই বাতানুকূল অ্যাম্বুল্যান্স (ইনসেটে)। নিজস্ব চিত্র

প্রকাশ পাল 
বৈদ্যবাটী শেষ আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০১৮ ০২:৪৪
Share: Save:

আলমারিতে ঠাসা বই। বেশির ভাগই ডাক্তারির। পড়ার টেবিলে সযত্নে রাখা দু’টো মোবাইল। এক পাশে সিঙ্গল‌ খাট। পরিপাটি করে চাদর পাতা।

নেই শুধু সেই ঘরের মালিক। প্রায় এক বছর ধরেই নেই। তিনি এখন শুধুই স্মৃতি! তবু ঘরটা রোজ ঝাড়পোঁছ করতে ভোলেন না বৈদ্যবাটীর বাদামতলার সুবীর চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী শাশ্বতীদেবী। দম্পতি জানেন, ছেলে আর ফিরবে না। তবু স্মৃতি হারাতে চান না তাঁরা।

তাঁদের ছেলে, চিকিৎসক সোমক চৌধুরী গত বছর ১৬ নভেম্বর ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি ব্লকের ছ’তলা থেকে পড়ে মারা গিয়েছিলেন।

ছেলের স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতেই রবিবার, পঞ্চমীতে বাদামতলা সর্বজনীন শারদোৎসব সমিতিকে একটি বাতানুকূল অ্যাম্বুল্যান্স দান করলেন‌ তাঁরা। ছেলের স্কুলের দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্রদের বৃত্তির জন্য দু’লক্ষ টাকার চেক দিলেন। বৈদ্যবাটীর কে সি চ্যাটার্জি স্ট্রিটে পৈতৃক দোতলা বাড়ির নিজেদের অংশ মাহেশ শ্রীরামকৃষ্ণ আশ্রমকে দান করলেন আধ্যাত্মিক ও সেবামূলক কাজের জন্য। একই সঙ্গে বৈদ্যবাটী বান্ধব সমিতি ক্লাবকে এক লক্ষ কুড়ি হাজার টাকার চেক দিলেন কমিউনিটি হল তৈরির জন্য। গত বার ষষ্ঠীতে বাড়ি এসেছিলেন সোমক। হাতে মায়ের জন্য শাড়ি। বাবার জন্য জামাকাপড়, জুতো। তার পরে এসেছিলেন ১১ নভেম্বর। দিন দু’য়েক ছিলেন। সেই শেষ ঘরে ফেরা। মায়ের সঙ্গে তাঁর শেষ কথা হয়েছিল ১৬ নভেম্বর। সোমক তখন অপারেশন থিয়েটারে। মাকে বলেছিলেন, ‘‘আমি এখন ওটি-তে। পরে কথা হবে।’’ আর ফোন আসেনি।

রবিবার সকালে ফ্ল্যাটের খানিক দূরে বৈদ্যবাটী বাদামতলার পুজোমণ্ডপে তখন সাজো সাজো রব। রাজ্যপাল এলেন উদ্বোধনে। তিনি ফিরে যাওয়ার পরেও বেশ কিছুক্ষণ অনুষ্ঠান হল। সেখানে সবাই সোমকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সোমকের স্কুল মাহেশ শ্রীরামকৃষ্ণ আশ্রম উচ্চ বিদ্যালয়ের সম্পাদক স্বামী শিবেশানন্দ, সেই সময়ের প্রধান শিক্ষক শশাঙ্কশেখর মণ্ডল—সবাই। অন্তর্মুখী যুবকটি কী ভাবে এমবিবিএস পাশ করলেন, তার পরে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এমএস করতে করতে সিনিয়র ডাক্তারদের আস্থাভাজন হয়ে উঠলেন— এ সবই শোনাচ্ছিলেন শশাঙ্কবাবু। তন্ময় হয়ে শুনছিলেন সবাই। স্কুলবেলার বন্ধু সায়ন্তন বলছিলেন পারস্পরিক সম্পর্কের কথা।

সবাই যখন ছেলের কথা বলছেন, সুবীরবাবু তখন চেয়ারের হাতল আঁকড়ে বসে। পরে বলেন, ১৬ নভেম্বরেও তিনটে অস্ত্রোপচার করেছিল ছেলেটা। তার পরে কী যে হল! সে দিন রক্তাক্ত সোমককে জরুরি বিভাগে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা শুরু হয়। কিন্তু বাঁচানো যায়নি। তার পর থেকে পৃথিবীটা যেন থমকে গিয়েছে সুবীরবাবু-শাশ্বতীদেবীর কাছে। ছেলের চলে যাওয়া আজও তাঁদের কাছে রহস্য।

চোখের জল ফেলেন গ্রামীণ ব্যাঙ্কের অবসরপ্রাপ্ত কর্মী সুবীরবাবু। বলেন, ‘‘ছেলে যেটুকু সেবা করতে পেরেছে, কলকাতায়। বৈদ্যবাটীর জন্য কিছু করার সুযোগটাই পায়নি। ও দেশ-দশের অনেক উপকার করতে পারত। তাই ওঁর স্মৃতিতে আমরা যে টুকু সামর্থ্য জনহিতের জন্য দিলাম।’’ আর কান্নাভেজা গলায় শাশ্বতীদেবীর স্বগতোক্তি, ‘‘এগারো মাস হয়ে গেল। ওর শেষ কথাটা কানে ভাসে, মা পরে কথা হবে। আর কোনও দিন কথা হবে না।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Charity Parents Ramakrishna Mission
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE