রাজ্যের বহু দৃষ্টিহীন মানুষ চোখের অপেক্ষায় দিন গুনছেন। তাঁদের কেউ দৃষ্টি ফিরে পাবেন, এই আশায় জীবদ্দশায় চক্ষুদানের অঙ্গীকার করেছিলেন জাঙ্গিপাড়ার এক বৃদ্ধ। কিন্তু মৃত্যুর পরে তাঁর সেই ইচ্ছা পূরণ হল না। হেলায় নষ্ট হল অমূল্য সম্পদ। আর এ জন্য তাঁর পরিবারের লোকজন দুষছেন সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতরের গা-ছাড়া মনোভাবকেই।
জাঙ্গিপাড়ার বাহিরগড় গ্রামের প্রণব সরকার (৭৪) নামে ওই বৃদ্ধ বৃহস্পতিবার রাতে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। ওই হাসপাতল চত্বরেই রয়েছে রিজিওনাল ইনস্টিটিউট অব অপথ্যালমোলজি (আরআইও) দফতর। তারাই চোখ গ্রহণের কাজ করে। প্রণববাবুর ছেলে সুদীপ্তবাবুর অভিযোগ, বাবার চক্ষুদানের জন্য রাত দেড়টায় আরআইও থেকে ‘ডেথ সার্টিফিকেট’-এর ফোটোকপি করে আনতে বলা হয়। অত রাতে দোকান খোলা ছিল না। মোবাইলে ছবি তুলে রাখার অনুরোধ করা হলেও লাভ হয়নি। শুধু তাই নয়, দু’পাতার ফর্ম দিয়ে সেটি পূরণ করতেও বলা হয়। পরিবারের পক্ষ থেকে শুধু সই করে দেওয়ার কথা বলা হলেও পাত্তা দেওয়া হয়নি। টালবাহানা চলতে থাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিয়মের গেরোয় চক্ষুদান করা যায়নি। এ নিয়ে আরআইও-তে অভিযোগও জানিয়েছেন সুদীপ্তবাবু।
প্রণববাবু জাঙ্গিপাড়া এলাকায় পরিচিত মুখ। পনেরো বছর ধরে তিনি জাঙ্গিপাড়া পঞ্চায়েতে সিপিএমের প্রধান ছিলেন। জাঙ্গিপাড়া টাউন লাইব্রেরির সম্পাদকও ছিলেন। জড়িয়েছিলেন চক্ষুদান আন্দোলনের সঙ্গে। বৃহস্পতিবার দুপুরে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। বাড়ির লোকজন তাঁকে প্রথমে জাঙ্গিপাড়া গ্রামীণ হাসপাতালে নিয়ে যান। রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ তাঁকে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।
মৃতের পরিবারের সদস্যেরা জানান, মৃত্যুর পরে প্রণববাবুর চক্ষুদানের জন্য ‘শ্রীরামপুর সেবাকেন্দ্র ও চক্ষুব্যাঙ্ক’-এর সহযোগী সংস্থা জাঙ্গিপাড়ার ‘রাজবলহাট কালচারাল সার্কেল ও সেবায়ন’-এর সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তাঁদের থেকে নম্বর নিয়ে আরআইও-তে ফোন করা হয়। কিন্তু ফোন বেজে যায়। রাত ১১টা নাগাদ আরআইও-তে গিয়ে ডাকাডাকি সত্ত্বেও কারও আওয়াজ মেলেনি।
তাঁরা দফতরের চার তলায় উঠে যান। অনেক ডাকাডাকির পরে এক মহিলা এবং এক পুরুষ চিকিৎসক বেরিয়ে আসেন। বিষয়টি তাঁদের জানানো হয়। রাত দেড়টা নাগাদ তাঁরা কর্নিয়া সংগ্রহ করতে আসেন। এসেই ‘ডেথ সার্টিফিকেটে’র ফোটোকপি নিয়ে আসতে বলেন। সরকারি নিয়ম হল, কারও চক্ষুদান করতে হলে তাঁর মৃত্যুর শংসাপত্রের ফোটোকপি গ্রহণকারী সংস্থাকে দিতে হয়। কিন্তু সুদীপ্তবাবুরা তা পারেননি।
সুদীপ্তবাবুর ক্ষোভ, ‘‘অত রাতে কোথা থেকে ফোটোকপি করিয়ে আনব? মোবাইলে ডেথ সার্টিফিকেটের ছবি তুলে রাখতে বলি। শনিবার জেরক্স দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিই। ওঁরা রাজি হলেন না। বাবার ইচ্ছে পূরণ করতে পারলাম না।’’
ঘটনায় ক্ষোভপ্রকাশ করেছে মরণোত্তর চক্ষুদান নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলি। রাজবলহাটের সংগঠনটির সদস্যদের বক্তব্য, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে গ্রামেগঞ্জে ঘুরে মরণোত্তর চক্ষু সংগ্রহ করতে হয়। আরআইও-র চিকিৎসকদের এমন অসহযোগিতা চক্ষুদান আন্দোলনকেই দুর্বল করবে। সংগঠনের সদস্য সুরজিৎ শীল বলেন, ‘‘তিন বছর আগেও একই পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক মোবাইলে ডেথ সার্টিফিকেটের ছবি তুলে রেখেছিলেন। পরের দিন জেরক্স পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। তখন কোনও সমস্যা হয়নি। এ ক্ষেত্রেও সেটা করা যেত।’’ ‘দুর্গাপুর ব্লাইন্ড রিলিফ সোসাইটি’র সাধারণ সম্পাদক কাজল রায় বা বসিরহাট চৌমাথার ‘সেবায়ন চক্ষুদান কেন্দ্র’-এর সহ-সম্পাদক হরশঙ্কর মণ্ডলও মনে করছেন, সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক সংবেদনশীল হলে এমন সমস্যা থাকে না।
মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে আরআইও-র অধিকর্তা অসীম চক্রবর্তী প্রথমে বলেন, ‘‘অফিসে এসে কথা বলবেন।’’ পরে যোগ করেন, ‘‘অভিযোগ যখন জমা পড়েছে, নিশ্চয়ই দেখে নেব।’’ আগামী শুক্রবার এ নিয়ে আরআইও-তে বৈঠক ডাকা হয়েছে বলে জানিয়েছেন শ্রীরামপুর সেবাকেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ চট্টোপাধ্যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy