অনাড়ম্বর: সাদামাটা মণ্ডপ পুজোর আগের সন্ধ্যা কাটল তাস খেলেই (বাঁ দিকে) গোন্দলপাড়া জুটমিলে। নিজস্ব চিত্র
কাজে যোগ দেওয়ার পরে প্রথম কয়েক বছর বিশ্বকর্মা পুজোর দিন আত্মীয়স্বজনকে চটকলে নিয়ে যেতেন মনোতোষ যাদব। পুজোর আনন্দ উপভোগের পাশাপাশি নিজের কাজের জায়গা ঘুরিয়ে দেখাতেন। গত বছর এই দিনে মিল চত্বরে পা মাড়াননি তিনি। এ বারও তাই। কারণ, দেড় বছর ধরে শ্রীরামপুরের ইন্ডিয়া চটকল বন্ধ।
চটকলের স্প্রিং বিভাগের শ্রমিক মনোতোষ বলেন, ‘‘এখন বালির একটা মিলে ঠিকা শ্রমিকের কাজ করি। সামান্য উপার্জনে সংসার চলছে। বিশ্বকর্মা পুজোর আনন্দ আর আমাদের ছোঁয় না।’’
সত্য শ্রীমানী ওই মিলে কাজে যোগ দেন ১৯৯৯ সালে। তিনি বলেন, ‘‘আগে মিলে বিশ্বকর্মা পুজোয় বড় মণ্ডপ হত। বাড়ির লোকেদের জন্য লাড্ডু দেওয়া হত। এখন অফিসঘরে নমো নমো করে পুজো হয়।’’ সত্যবাবুও এখন সংসার চালাতে অন্য মিলে ঠিকাদারের অধীনে কাজ করছেন। হুগলি শিল্পাঞ্চল জুড়েই তাঁদের মতো অসংখ্য শ্রমিকের কাছে বিশ্বকর্মা পুজোর আনন্দ এখন ফিকে।
এই জেলায় গঙ্গাপাড়ে শিল্পাঞ্চলে একের পর এক কারখানা বন্ধ। কোনও কারখানায় তালা ঝুলেছে স্থায়ী ভাবে। বন্ধ কারখানার চৌহদ্দিতে মাথা তুলেছে আবাসন। কোনও কারখানা খাতায়-কলমে পাকাপাকি ভাবে বন্ধ না হলেও তালা কবে খুলবে বা আদৌ খুলবে কি না, শ্রমিকের সে উত্তর নেই। প্রবীণেরা বলছেন, বিশ্বকর্মা পুজোর নিষ্প্রভতাই বলে দেয়, এই শিল্পাঞ্চলের চেহারা।
স্থানীয় ইতিহাস চর্চা করেন শ্রীরামপুরের বাসিন্দা, অশীতিপর অসিত দত্ত। তাঁর কথায়, ‘‘এক সময় হিন্দমোটর, কোন্নগর, রিষড়া, শ্রীরামপুরের বিভিন্ন কল-কারখানা বিশ্বকর্মা পুজো ঘিরে ঝলমল করত। এখন বহু কারখানা বন্ধ। কোনওটা টিমটিম করে চলছে। তাই পুজোর রমরমাও কমেছে। কবে বিশ্বকর্মা পুজো এল, কবে গেল— এখন বুঝতেই পারি না। আকাশে ঘুড়ি দেখে দিনটা মালুম করতে হয়।’’
মঙ্গলবারের পড়ন্ত বিকেলে গোন্দলপাড়া চটকলের পাঁচিলের ধারে বসে তাস খেলছিলেন সেখানকার অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক সীতারাম চৌধুরি। বৃদ্ধের কথায়, ‘‘আগে শ্রমিক পরিবারের লোকজনকে বিশ্বকর্মা পুজোর দুপুরে খাওয়ানো হত। এই দিনটায় বাইরের লোক মিলে ঢুকতে পারতেন। ভাবতে আশ্চর্য লাগে, মিলে এখন পুজোই হয় না।’’
এলাকায় ঘুরে দেখা গেল, সাকুল্যে চারটি পুজো হচ্ছে। আয়োজন বলতে ম্যাড়ম্যাড়ে কাপড়ে ঘেরা একফালি মণ্ডপ। শ্রমিকরা জানালেন, এক সময় পুজোর সংখ্যা ছিল ২০টি। পুজোর আগের দিন থেকেই উৎসব শুরু হয়ে যেত। গোটা মহল্লা আলোয় ঝলমল করত। বাইরে থেকেও বহু মানুষ পুজো দেখতে আসতেন। প্রৌঢ় কার্তিক সাউয়ের স্বগতোক্তি, ‘‘এখানে মেলা বসে যেত। আর এখন...।’’ ওই চত্বরে রিকশাচালকদের পুজো গত বছর থেকে তা বন্ধ। সুরেশ যাদব নামে এক রিকশাচালকের কথায়, ‘‘মিলের শ্রমিকদের চাঁদাতেই পুজো হত। এখন ওদেরই সংসার চলে না। চাঁদা চাইব কোন মুখে! তাই পুজো বন্ধ।’’
চন্দননগরের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক কল্যাণ সমিতির উপদেষ্টা বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়ের খেদ, ‘‘নয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বিশ্বকর্মা পুজোয় শিল্পাঞ্চলে উৎসবের মেজাজ ছিল। শ্রমিক পরিবারের লোকেরা নতুন জামা পড়তেন। পুজোর আগেই বোনাস মিলত অনেক কারখানায়। কিন্তু এখন শোচনীয় অবস্থা। বন্ধ কারখানার ভিতরে যন্ত্রপাতিতে মরচে পড়ছে। কোথাও তা চুরি যাচ্ছে। পেটের ভাত জোগাড় করতেই শ্রমজীবী মানুষ হিমশিম খাচ্ছেন। তাই, পুজোর সে দিন ফিরবে কি করে!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy