Advertisement
১৯ জানুয়ারি ২০২৫
Coronavirus

সুর বাঁধছে না কেউ, স্তব্ধ হারমোনিয়াম

নোটবন্দি এবং জিএসটি-র ধাক্কায় আগে থেকেই নড়বড়ে অবস্থা ছিল ছোট শিল্প-কারখানার। লকডাউনে এসে তা মুখ থুবড়ে পড়েছে। মালিকেরা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন। দেওয়ালে পিঠ ঠেকছে শ্রমিকদের। কবে ঘুরে দাঁড়াবে অর্থনীতি, তার কোনও দিশা দেখতে পাচ্ছেন না বিশেষজ্ঞেরাও। কেমন আছেন ওই সব শিল্প-কারখানার শ্রমিক-মালিকেরা? খোঁজ নিল আনন্দবাজার। মাসখানেক আগেও আরামবাগের ১০ নম্বর ওয়ার্ডের ঘিয়া মাঝপাড়ায় জাহারুলদের তল্লাটে সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত শোনা যেত হারমোনিয়ামের সা-রে-গা-মা।

হারমোনিয়ােমর যন্ত্রাংশ অর্ধেক তৈরি হয়ে পড়ে রয়েছে। ছবি: সঞ্জীব ঘোষ

হারমোনিয়ােমর যন্ত্রাংশ অর্ধেক তৈরি হয়ে পড়ে রয়েছে। ছবি: সঞ্জীব ঘোষ

পীযূষ নন্দী
শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০২০ ০৩:২৯
Share: Save:

সুরের বিচ্যুতি সহ্য হয় না জাহারুলের।

সপ্ত সুরের কোনওটির একটু এ দিক-ও দিক হলেই হারমোনিয়াম খুলে ফেলেন যুবক। আবার নতুন করে তৈরি করেন। আবার ‘রিড’ টেপেন। নির্গত সুর ঠিক কিনা, বুঝিয়ে দেয় তাঁর সতর্ক কান। কিন্তু তাঁর জীবনটাই এখন পুরোপুরি বেসুরো হয়ে গিয়েছে।

মাসখানেক আগেও আরামবাগের ১০ নম্বর ওয়ার্ডের ঘিয়া মাঝপাড়ায় জাহারুলদের তল্লাটে সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত শোনা যেত হারমোনিয়ামের সা-রে-গা-মা। পাড়ার প্রায় ১৫০টি পরিবার বংশানুক্রমে হারমোনিয়াম তৈরি করে। ছোট ছোট কারখানা। মালিক রয়েছেন জনা চোদ্দো। তাঁরা কারিগরও। কিন্তু লকডাউনে সব বন্ধ। অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছেন ওই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শেখ জাহারুল, শেখ ইউসুব, ফিরোজ মহম্মদ, মেতিয়ার বক্সরা। তাঁরা জানান, কারখানাগুলিতে জমে রয়েছে ২-৩ লক্ষ টাকার হারমোনিয়াম। বিক্রি নেই। নতুন বরাতও নেই।

ঘিয়ার হারমেনিয়ামের কদর কলকাতা-সহ রাজ্যের বহু জেলা এবং দিল্লি, মুম্বই, অসমের মতো ভিন্‌ রাজ্যেও রয়েছে। হারমোনিয়াম মেরামতও করা হয় এখানে। ‘দক্ষ কারিগর’ হিসাবে বিশেষ খ্যাতি আছে ঘিয়ার মাঝপাড়ার বাসিন্দাদের।

বছর চৌত্রিশের জাহারুল নিজে সুর বাঁধার কারিগর। আবার মালিকও। তাঁর আক্ষেপ, “খুব কষ্টে আছি আমরা। কেউ কিছু ভাবছে না।’’

এমন বিপর্যয় আগে দেখেনি এ পাড়া। বৃদ্ধ কারিগর শেখ রহমান বলেন, ‘‘এখানের হারমোনিয়াম শিল্প ১০০ বছরেরও বেশি পুরনো। কখনও হারমোনিয়ামের সুর বাঁধার আওয়াজ বন্ধ হয়নি। এমন কর্মহীন হয়ে থাকতে হয়নি। এতগুলো মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব আতঙ্কে আছি।”

কারিগররা জানালেন, একটি হারমোনিয়াম তৈরিতে প্রায় ২২ রকম সরঞ্জাম লাগে। কাঠ, পিতলের ‘রিড’, স্টিলের রিং, মার্বেল পেপার, হাতল, স্ক্রু, কব্জা ইত্যাদি। কাঠের খোল তৈরি থেকে শুরু করে সুর বেঁধে হারমোনিয়াম পালিশ করা পর্যন্ত সময় লাগে প্রায় ১০ দিন। কারিগরদের মধ্যে ভাগ আছে। কেউ শুধু খালি কাঠের খোল বানান। কেউ সেই খোলে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ বসান। কেউ শুধু সুর বাঁধেন।

শ্রমিকের সংখ্যা অনুযায়ী বিভিন্ন কারখানায় মাসে ৪০ থেকে ৬০টি হারমোনিয়াম তৈরি হয়। বিশেষ, মাঝারি এবং সাধারণ— এই তিন মানের হারমোনিয়াম তৈরি হয়। সেগুলির পাইকারি দর ৮ হাজার ৩০০ টাকা থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত। কারাখানা-মালিকদের দাবি, সমস্ত খরচ বাদ দিয়ে হারমোনিয়ামপিছু লাভ থাকে ৫০০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা।

শেখ ফিরোজ নামে এক কারখানা-মালিক জানান, এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে টানা ছ’মাস বাজার ভাল থাকে। তাই প্রতি বছরের মতো এ বারও হারমোনিয়াম তৈরি করে রাখা হয়েছিল। মারণ-করোনা সব শেষ করে দিল। শেখ তোতন নামে এক শ্রমিক বলেন, ‘‘হারমোনিয়ামের কাঠের কাজটা করে মাসে ১০ হাজার টাকা পেতাম। এখন সংসার চলছে না। মালিকরা পাওনা ছাড়াও কিছু অগ্রিম দিয়েছিলেন। তা-ও শেষ।”

সুদিনের অপেক্ষায় রয়েছে মাঝপাড়া।

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Health Coronavirus Lockdown
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy