স্তব্ধ: ফাঁকা সিঙ্গুর স্টেশন। নিজস্ব চিত্র
সকালে ওঁরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন। একের পর এক ‘বাবু’র বাড়িতে গিয়ে কাজ করতে হয়। ঘর মোছা, বাস মাজা, কাপড় কাচা— কত কাজ! ফিরতে রাত। এই তাঁদের রোজনামচা। কিন্তু, করোনা পরিস্থিতির জেরে তাঁরাও উদ্বেগে। বাস-ট্রেন বন্ধ হচ্ছে। কর্মস্থলে কী করে পৌঁছবেন? কাজে যেতে না পারলে ‘মাইনে’ বন্ধ হয়ে যাবে না তো? কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেওয়া হবে না তো! এমন নানা দুশ্চিন্তা কপালে ভাঁজ ফেলেছে তাঁদের।
চলতি কথায় ওঁরা ‘কাজের লোক’। পোশাকি নাম ‘পরিচারিকা’। গোটা রাজ্যে বহু মহিলা এই কাজের সঙ্গে যুক্ত। হুগলি জেলায় এই সংখ্যা বেশ কয়েক হাজার। তাঁদের মধ্যে অনেকেই ট্রেনে-বাসে চেপে কাজে যান। করোনার জেরে অনেকেই বাস-ট্রেনে চড়া কমিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু রোজগার কি পুরোপুরি বন্ধ হবে? ভয়ে কাঁটা সকলেই।
সবিতা মণ্ডল ডানকুনিতে ভাড়া থাকেন। মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। মেয়ে অবশ্য মায়ের কাছেই থাকেন। মা-মেয়ে পরিচারিকার কাজ করেন। ডানকুনি থেকে সকাল সাড়ে ৬টার ট্রেন ধরে বরাহনগর। সেখানে সবিতা ৬টি বাড়িতে কাজ করেন। মেয়ে চারটিতে। মাসে কোনও বাড়িতে মেলে ৭০০ টাকা। কোনও বাড়িতে ৮০০। এই আয়েই গ্রাসাচ্ছাদন। করোনা-পরিস্থিতিতে কী করবেন, তাঁরা ভেবে পাচ্ছেন না। সবিতার কথায়, ‘‘কী মুশকিলে পড়েছি! বাড়ি থেকে বেরনো এবং কাজের বাড়িতে ঢোকার সময় সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিচ্ছিলাম। কিন্তু কোনও কোনও বাড়িতে বলছে, পোশাক ছেড়ে কাজ করতে। বলুন তো ব্যাগে ক’টা পোশাক নিয়ে যাব?’’
এই অবস্থায় কোনও রকমে কাটলেও ট্রেন বন্ধের খবরে তাঁদের মাথায় হাত। সবিতা বলেন, ‘‘আমাদের সাপ্তাহিক ছুটির ব্যাপার নেই। মাঝেমধ্যে প্রয়োজনে এক-দু’দিন ছু’টি চেয়ে নিতে হয়। ট্রেন বন্ধ থাকলে তো মহা মুশকিল। বাবুরা ছুটির দিনের টাকা দেবেন? তার থেকেও বড় প্রশ্ন, কাজ ছাড়িয়ে দেবেন না তো?’’
একই ভাবনা বেগমপুরের অর্চনা মাঝিরও। তিনি প্রায় আড়াই দশক ধরে পরিচারিকার কাজ করছেন। সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে অটোতে বেগমপুর স্টেশন, সেখান থেকে ট্রেনে বেলুড়। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা একই রুটিন। টানা এক সপ্তাহ কাজে যেতে না-পারলে আদৌ কাজ থাকবে কিনা, এমন ভাবনা তাঁরও। তাঁর কথায়, ‘‘বেশি দিন ছুটি নেওয়ার কথা আমরা ভাবতেই পারি না। কিন্তু ট্রেন বন্ধ থাকলে তো যাওয়ার উপায় থাকবে না। তখন কী হবে?’’
‘জনতা কার্ফু’র জন্য অর্চনা-সবিতার মতোই রবিবার ‘ছুটি’ নিয়েছিলেন জনাইয়ের ঝর্না দাস। তিপান্ন বছরের এই মহিলা আয়ার কাজ করেন। এই কাজে রোজ তাঁকেও বরাহনগরে যেতে হয়। মজুরি দৈনিক আড়াইশো টাকা। ছুটি নিলে মজুরি মেলে না। ঝর্নার কথায়, ‘‘টিভিতে, ট্রেনে, বাসে সব জায়গাতেই তো করোনা নিয়ে আলোচনা শুনছি। সবাই বলছেন, বাড়ি থেকে না বেরোতে। সাবধানে থাকতে। কিন্তু এই ভাবে আমাদের চলবে কী করে? আমরা তো দিন আনি দিন খাই। কী বিপদে পড়া গেল!’’
পরিচারিকাদের নিয়ে ভাবিত তাঁদের সংগঠনও। ‘সারা বাংলা পরিচারিকা সমিতি’র সদস্যেরা জানান, গোটা রাজ্যে তাদের প্রায় ২৫ হাজার সদস্য রয়েছেন। হুগলিতে এই সংখ্যা হাজার তিনেক। তার বাইরেও বহু মহিলা এই কাজের সঙ্গে যুক্ত। সংগঠনের রাজ্য সভানেত্রী লিলি পাল বলেন, ‘‘এমনিতেই অসংগঠিত ক্ষেত্রের এই সব মহিলারা সামাজিক সুরক্ষার দিক থেকে বঞ্চিত। বাবুরা হুটপাট করে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেন। এখন তো করোনার জন্য আরও সমস্যা হল।’’
অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক নিয়েও চিন্তিত ওই সংগঠন। লিলি বলেন, ‘‘বাড়ির অন্দরমহলে ঢুকে পরিচারিকাদের সাফাইয়ের কাজ করতে হয়। কার বাড়িতে কী রোগ লুকিয়ে আছে, কেউ জানেন না। তাই পরিচারিকাদের সুরক্ষার জন্যেও ছুটি খুব জরুরি।’’ ওই সংগঠনের দাবি, করোনা পরিস্থিতি যত দিন না কাটছে, ততদিন পরিচারিকাদের সবেতন ছুটির ব্যবস্থা করুক রাজ্য সরকার। এই দাবিতে তারা শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটকের কাছে স্মারকলিপি দেবে বলে জানিয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy