Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪

হাঁড়িই চড়ল না ডুমুরদহে 

বলাগড়ের ডুমুরদহ গ্রামের নতুনপাড়ায় অনেক বাড়িতেই শনিবার হাঁড়ি চড়েনি। মাঝেমধ্যে কান্নার রোল উঠেছে। শুক্রবারের রাত গ্রামটাকে যেন তছনছ করে দিয়েছে!

শোকার্ত: মৃতের পরিজনরা। নিজস্ব চিত্র

শোকার্ত: মৃতের পরিজনরা। নিজস্ব চিত্র

প্রকাশ পাল ও সুশান্ত সরকার
বলাগড় শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০১৮ ০২:৪৮
Share: Save:

গোটা গ্রামটাই যেন থম মেরে গিয়েছে!

বলাগড়ের ডুমুরদহ গ্রামের নতুনপাড়ায় অনেক বাড়িতেই শনিবার হাঁড়ি চড়েনি। মাঝেমধ্যে কান্নার রোল উঠেছে। শুক্রবারের রাত গ্রামটাকে যেন তছনছ করে দিয়েছে!

প্রৌঢ় ননীগোপাল মণ্ডল শুক্রবার বিসর্জনের শোভাযাত্রার লাইন ঠিক করছিলে‌ন। তখনই ‘যমদূতের’ মতো গাড়িটা ঢুকে পড়ে ভিড়ে। ননীগোপালের পাশেই এক জন লুটিয়ে পড়েন। মুখ, কান, নাক দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে। ননীগোপাল তাঁকে ধরাধরি করে তুলছিলেন। এর মধ্যেই এক জন খবর দেন, অঞ্চল অফিসের (পঞ্চায়েত দফতর) সামনে ননীগোপালের ছেলে চিরঞ্জিৎ পড়ে রয়েছেন। প্রৌঢ়ের কথায়, ‘‘ছুটে গিয়ে দেখি, ছেলে খুব কষ্টে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। একটু জল খাওয়ালাম। সবাই হাসপাতালে নিয়ে গেল। আমিও গেলাম। শুনলাম, ছেলে আর নেই।’’

শুধু চিরঞ্জিৎ নন, শুক্রবার, বিজয়ী দশমীর রাতে ডুমুরদহের বালক সঙ্ঘের বিসর্জনের জন্যই শোভাযাত্রায় একটি গাড়ির ধাক্কায় মৃত্যু হয় কার্তিক মালিক, মনোরঞ্জন বাছার, বিমল রায় এবং শেখ জাকির হোসেন ওরফে খোকারও। জখম হন অনেকে। মাস কয়েক আগে ছোট ছেলে ইন্দ্রজিতের অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর থেকে বড় ছেলে চিরঞ্জিৎই আগলে রেখেছিলেন ননীগোপাল এবং মা আলোকলতাকে। চিরঞ্জিৎ বেসরকারি সংস্থায় কাজের পাশাপাশি দূরশিক্ষায় বিএ পড়ছিলেন। কাঁচাবাড়ি সারানোর জন্য ইট কিনে এনেছিলেন। ননীগোপাল‌ বলছিলেন, ‘‘এখন কী ভাবে বাঁচব আমরা! শুক্রবার সন্ধ্যায় ছেলে বলেছিল, বিসর্জ‌ন দিয়ে এসে ভাত খাবে। খাওয়া আর হল না।’’

কার্তিক মালিকের বাড়ির এক দিকে টালির চাল, এক দিকে প্লাস্টিকের ছাউনি। মাটির মেঝে। ডুমুরদহ বাসস্ট্যান্ডের কাছে তাঁর পানের গুমটি। স্ত্রী রাখি পরিচারিকার কাজ করেন। বড় ছেলে অতনু অষ্টম, আর ছোট ছেলে অনুমেষ পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। স্বামীকে হারিয়ে কী ভাবে ছেলেদের মানুষ করবে‌ন, সেটাই চিন্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে রাখির।

বিমল রায় ছিলেন পরিবারের একমাত্র রোজগেরে। কলকাতায় পোশাকের দোকা‌নে কাজ করতেন। কষ্ট করে বড় মেয়ে ডালিয়ার বিয়ে দিয়েছেন। ছোট মেয়ে পিয়ালি বিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। ছেলে নয়ন সপ্তম শ্রেণির পড়ুয়া। ডালিয়া বলেন, ‘‘বাবা-মা দু’জনেই মণ্ডপে গিয়েছিল। চেঁচামেচি শুনে গিয়ে দেখি, বাবা পড়ে রয়েছে। মায়ের পায়ে অল্প লেগেছে।’’

মনোরঞ্জন বাছারও পরিবারের একমাত্র রোজগেরে ছিলেন। স্ত্রী কাকলি এবং একাদশ শ্রেণির পড়ুয়া ছেলে মনোজকে নিয়ে সংসার। তাঁদের এক প্রতিবেশী বলেন, ‘‘মনোরঞ্জনদা বছর খানেক আগে ধার করে মেয়ের বিয়ে দিয়েছে‌ন। এখন পরিবারটার কী হবে! ছেলেটা উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করলে প্রশাসনের তরফে ওর জন্য কাজের ব্যবস্থা করলে ভাল হয়।’’ জাকিরের মৃত্যুতে ইসলামপাড়াতেও শোকের ছায়া। শেখ আবুল হোসেন নামে তাঁর এক আত্মীয় বলেন, ‘‘এখানে সম্প্রীতির বাতাবরণ রয়েছে। মুসলিম সম্প্রদায়ের অনেকেই ওই পুজোয় যান। জাকিরও যেতেন।’’

শনিবার সকালে জেলার (গ্রামীণ) পুলিশ সুপার সুকেশ জৈন-সহ পদস্থ পুলিশ আধিকারিকরা ঘটনাস্থলে আসেন। গ্রামবাসীরা অভিযোগ করেন, ওই রাস্তায় বেপরোয়া গাড়ি চলে। প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনাস্থলে ‘হাম্প’ তৈরি এবং ট্রাফিক পুলিশ মোতায়েনের দাবি ওঠে। পুলিশ সুপার জানিয়েছেন, ইতিমধ্যেই ওখানে গাড়ি নিয়ন্ত্রণের জন্য পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। দুর্ঘটনা এড়াতে দু’-তিন দিনের মধ্যে হাম্পও বসানো হবে।’’ বিডিও বলেন, ‘‘ট্রাফিক ব্যবস্থা ঢেলে সাজার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। তবে মানুষকেও সচেতন হতে হবে।’’

দুর্ঘটনার পর থেকে প্রতিমা মণ্ডপের সামনে নামিয়ে রাখা হয়েছিল। শনিবার সকালে পুকুরে বিসর্জন দেওয়া হয়। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মহাদেব পাত্র বলেন, ‘‘সন্ধ্যা থেকে সিঁদুর খেলা, গান চালিয়ে নাচ, হুল্লোড় চলছিল। এক মিনিটের মধ্যে গাড়িটা সব কিছু শেষ করে দিল। চোখের সামনে ওদের লুটিয়ে পড়তে দেখলাম।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Accident Dumurdaha Death
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy