Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
Thief

নৌকা করে ‘কাজে’ এসে শ্রীঘরে গেল ‘নিশিকুটুম্ব’

মনোজ বসুর উপন্যাসের ‘চোর-শিরোমণি’কে দিনের বেলায় দেখা যায় না। রাতে বাড়ি বাড়ি ধর্না দেয়। তাই সে ‘নিশিকুটুম্ব’।

ধৃত সইফুদ্দিন। —নিজস্ব চিত্র

ধৃত সইফুদ্দিন। —নিজস্ব চিত্র

প্রকাশ পাল
বলাগড় শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০২০ ০২:৪৮
Share: Save:

নিশুত রাতে নৌকা ভিড়ছিল গঙ্গাপাড়ে। চটপট ‘কাজ’ সেরে সে ফিরে যাচ্ছিল ভোরের আলো ফোটার আগেই। তার ঝুলিতে অন্তত ৫০০ বাড়িতে চুরির অভিজ্ঞতা! কাল হল ছ’মাস আগে জিরাটে এক সিভিক ভলান্টিয়ারের বাড়িতে হানা দিয়ে।

মনোজ বসুর উপন্যাসের ‘চোর-শিরোমণি’কে দিনের বেলায় দেখা যায় না। রাতে বাড়ি বাড়ি ধর্না দেয়। তাই সে ‘নিশিকুটুম্ব’। হুগলির গুপ্তিপাড়ার রামপুরের শেখ সইফুদ্দিনও যেন আর এক ‘সাহেব’! চোরেদের মহলে তার মস্ত নামডাক। চৌর্যবৃত্তিতে তার এমন দক্ষতা, খালি হাতে ফেরা ধাতে নেই!

কয়েক দিন আগে সেই সইফুদ্দিনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তার বছর সাত-আটেকের ‘কেরিয়ার’ শুনে দুঁদে গোয়েন্দারা থ! জেরায় সইফুদ্দিন তাঁদের জানিয়েছে, মাসে গড়ে ছ’-সাতটি বাড়িতে সে হানা দেয়। অন্তত ৫০০ বাড়িতে সে চুরি করেছে। হুগলির বলাগড়-পান্ডুয়া, পূর্ব বর্ধমানের কালনা-মেমারি এবং নদিয়ার শান্তিপুর-রানাঘাট ও কৃষ্ণনগর— তিন জেলার সাতটি থানা এলাকা জুড়ে তার ‘সাম্রাজ্য’। লকডাউন-পর্বে শুধু কালনাতেই ৩০টি বাড়িতে সে চুরি করেছে।

পুলিশের দাবি, ছিঁচকে চুরির মাধ্যমে সইফুদ্দিনের এই জগতে প্রবেশ। পড়াশোনা বিশেষ না-জানলেও চুরিবিদ্যায় হাত পাকাতে সময় লাগেনি।

যে ভাবে গড়গড় করে গোয়েন্দাদের নিজের ‘কেরিয়ারের’ কথা জানিয়েছে বছর পঁয়ত্রিশের যুবকটি, অনেকের কাছে তা গল্পের মতোই। সইফুদ্দিন জানিয়েছে, গোড়ায় সে ছিল ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’। ঘুরে ঘুরে বাড়ি দেখে আসত। ফাঁকা বা শুধু বয়স্ক লোক রয়েছেন— এমন বাড়িই ছিল ‘টার্গেট’। গভীর রাতে চলত হাতসাফাই। পরে লোক লাগিয়ে ‘রেইকি’ শুরু করে। ফাঁকা বাড়ি, কোন বাড়িতে শুধু বয়স্ক মানুষ আছেন, কে ব্যাঙ্ক থেকে মোটা টাকা তুলেছেন— তথ্য তার মুঠোয় চলে আসে। ক্রমে চুরির ধরনেও বদল আনে। জানলা দিয়ে ক্লোরোফর্ম স্প্রে করে লোকজনকে অচেতন করে দিত সে। তার পরে তালা ভেঙে অবাধে ‘অপারেশন’ সেরে বেরিয়ে আসত। সে জানে, ক্লোরোফর্ম নাকে গেলে তিন-চার ঘণ্টা ঘুম ভাঙে না। অতএব ধীরেসুস্থে আলমারি খুলে বা ভেঙে গয়না-টাকা হাতানো যায়।

পুলিশের একাংশের দাবি, শুরুতে নিজের এলাকায় ‘ভালমানুষ’ হয়ে থাকলেও পরেও সেখানেও চুরি করা ধরেছিল সইফুদ্দিন। গ্রামবাসীদের সন্দেহ, পুলিশের খোঁজখবর বাড়ে। পুলিশের নাগাল এড়াতে সে রানাঘাটে চলে যায়। সেখানে শ্রীনগর পল্লি এবং সাধুরবাগান এলাকায় দু’টি ঘর ভাড়া নেয়। পড়শিদের বলে, তার নাম রাজু। রাত-পাহারাদারের কাজ করে। তার হাতে-টানা নৌকা রয়েছে। হুগলি বা পূর্ব বর্ধমানে এলে দু’জন মাঝি পৌঁছে দেন। নৌকায় তালা কাটা মেশিন, ক্লোরোফর্ম, ছেনি-হাতুড়ির সঙ্গে থাকত সাইকেল। নৌকা থেকে নেমে সাইকেলে সে পৌঁছে যেত গন্তব্যে। কখনও আবার শাগরেদের মোটরবাইকে। ‘কাজ’ শেষে নৌকাতেই ফিরে আসত। চুরির গয়না নিজেই গলিয়ে কালনা বা শান্তিপুরে লোক মারফত বিক্রি করত।

ছ’মাস আগে জিরাটে এক সিভিক ভলান্টিয়ারের বাড়িতে আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে ডাকাতি হয়। তদন্তে জানা যায়, ঘটনার পান্ডা সইফুদ্দিনই। পুলিশ তাকে ধরতে উঠেপড়ে লাগে। তার গতিবিধির খোঁজ পেয়ে দিন কয়েক আগে বলাগড় থানার ওসি সুন্দরগোপাল মুখোপাধ্যায় এবং গুপ্তিপাড়া ফাঁড়ির ইনচার্জ আসিফ আলি মোল্লার নেতৃত্বে পুলিশ ওৎ পাতে। রাতের অন্ধকারে কালনায় যাওয়ার পথে গুপ্তিপাড়ায় গঙ্গার ঘাট থেকে এক শাগরেদ-সহ সইফুদ্দিনকে পুলিশ পাকড়াও করে। তার বাড়ি থেকে আগ্নেয়াস্ত্র, নগদ টাকা, সোনার গয়না, চুরির কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন সরঞ্জামও মিলেছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।

হুগলি জেলা (গ্রামীণ) পুলিশের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘জিরাটের ডাকাতির কথা সইফুদ্দিন স্বীকার করেছে। জানিয়েছে, সেটাই তার প্রথম ডাকাতি। সে আসলে পুরোদস্তুর চোর। চুরিতে তার আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে।’’ পুলিশের দাবি, সে গাঁজাও পাচার করে। তার জিম্মা থেকে ৩০ কেজি গাঁজা বাজেয়াপ্ত হয়েছে।

ধরা পড়ার পরেও সইফুদ্দিনের মধ্যে বিশেষ হেলদোল দেখা যায়নি। চলন-বলনে নিপাট ভদ্র। এক দারোগার রসিকতা, ‘‘সইফুদ্দিন যেন চৌর্যবৃত্তির ঐতিহ্যের ধারকবাহক! টাকা-গয়নাতেই খুশি। কাজে গেলে কোনও মহিলার দিকে ফিরেও দেখত না। রাতের অতিথি আমাদেরই যা ঘুম ছুটিয়ে দিয়েছিল!’’

(তথ্য সহায়তা: সুশান্ত সরকার)

অন্য বিষয়গুলি:

Thief Balagar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy