Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪

হচ্ছে নতুন আবাসন, চুঁচুড়ায় নিকাশি তিমিরেই

নগরায়নের হাত ধরে একের পর এক আবাসন প্রকল্পে ঢাকছে শহর। কিন্তু বেহাল নিকাশি ব্যবস্থার সুরাহা হল কই? বছর পাঁচেক আগেও হুগলির জেলা সদর চুঁচুড়ায় জি টি রোড-সহ বড় রাস্তারগুলির আশপাশে যে জমির দাম কাঠাপ্রতি ছিল এক-দেড় লক্ষ টাকা, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬-৮ লক্ষে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ফ্ল্যাটের দামও।

শহর জুড়ে এ ভাবেই ছড়িয়ে পড়ছে কংক্রিটের জঙ্গল। ছবি: তাপস ঘোষ।

শহর জুড়ে এ ভাবেই ছড়িয়ে পড়ছে কংক্রিটের জঙ্গল। ছবি: তাপস ঘোষ।

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ অগস্ট ২০১৪ ০০:২৬
Share: Save:

নগরায়নের হাত ধরে একের পর এক আবাসন প্রকল্পে ঢাকছে শহর।

কিন্তু বেহাল নিকাশি ব্যবস্থার সুরাহা হল কই?

বছর পাঁচেক আগেও হুগলির জেলা সদর চুঁচুড়ায় জি টি রোড-সহ বড় রাস্তারগুলির আশপাশে যে জমির দাম কাঠাপ্রতি ছিল এক-দেড় লক্ষ টাকা, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬-৮ লক্ষে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ফ্ল্যাটের দামও। কামারপাড়া, কনকশালি, বড়বাজার, খড়ুয়াবাজারের মতো শহরের অভিজাত এলাকাগুলিতে বর্গফুটপ্রতি ফ্ল্যাটের জন্য ক্রেতাদের দাম দিতে হচ্ছে তিন থেকে চার হাজার টাকা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেড়শো বছরের চৌকাঠে দাঁড়ানো হুগলি-চুঁচুড়া পুরসভা এখনও সুষ্ঠু নিকাশি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারল না বলে অভিযোগ রয়েছে বহু বাসিন্দারই।

ফি-বছর অল্প বৃষ্টিতেই জল জমে যায় বেশ কিছু ওয়ার্ডে (১, ২, ৭, ১৪, ১৭ এবং ২২ নম্বর)। বহু কাঁচা নালা এখনও পাকা হয়নি। সংস্কারের কাজও নিয়মিত হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে পুর এলাকার বহু বাসিন্দারা। ফলে, বর্ষায় নালা উপচে আসা নোংরা জল মাড়িয়েই যাতায়াত করতে হয় তাঁদের।

অথচ, এক সময়ে গঙ্গাকে দূষণমুক্ত রাখতে ওলন্দাজরা এ শহরে যে নিকাশি ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল, তা দেখে আজও বিস্মিত হন গবেষকরা। কিন্তু সেই নিকাশি-নালাকে বাঁচিয়ে রাখার দায় কারও নেই বলে আক্ষেপ রয়েছে বহু প্রবীণ মানুষের। তাঁদের মতে, ঘণ্টাঘাটের কাছে সুপরিকল্পিত ভাবে গড়ে তোলা নিকাশি-নালাটি আজও অক্ষত থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে তা অব্যবহৃত।

চুঁচুড়ার ইতিহাস, নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চর্চা করে চলেছেন সপ্তর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “হুগলি-চুঁচুড়া শহর জুড়ে বেশ কয়েক কিলোমিটার এলাকায় ডাচদের তৈরি নিকশি নালা ছিল। যা অন্তত ১৪ ফুট চওড়া এবং ২০ ফুট গভীর। শহরের কোথাও কোথায় ধস নামলে দেখা যায় নীচে জল বইছে। ওই নালা এমন ভাবে তৈরি করা হয়েছে যে তার উপরে নির্মাণ হলেও নালার কোনও ক্ষতি হবে ন। পাশাপাশি মাটির নীচে থাকায় দূষণেরও আশঙ্কা নেই।”

ওই নালা সংস্কার করে যদি কাজে লাগানো যেত, তা হলে এখানকার বেহাল নিকাশি ব্যবস্থার কিছুটা হলেও সুরাহা হত। এমনই মত শহরের বেশ কয়েকজন বাস্তুকার ও ইতিহাসবিদের।

পুরপ্রধান গৌরীকান্ত মুখোপাধ্যায় অবশ্য দাবি করেছেন, “যে পদ্ধতিতে ওই নালা তৈরি হয়েছে তা সংস্কারের কোনও পরিকাঠামো পুরসভার হাতে নেই। নেই ওই নালার মানচিত্রও। ফলে সমস্যা হচ্ছে। নালাগুলি সংস্কারের কাজ পর্যায় ক্রমে হচ্ছে। নিকাশি সমস্যার স্থায়ী সুরাহার জন্য নতুন করে প্রকল্প সাজানো হচ্ছে।” কিন্তু শহরের ঐতিহ্য রক্ষায় পুরসভা যে এখনও কোনও নির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে উঠতে পারেনি সে কথাও মেনে নিয়েছেন গৌরীকান্তবাবু। তিনি বলেন, “সম্প্রতি এ নিয়ে রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের সঙ্গে পুরসভার বৈঠক হয়েছে। কমিশন রাজ্য সরকারকে এ নিয়ে রিপোর্ট দেবে। তার ভিত্তিতেই পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।” তবে, ঐতিহ্যমণ্ডিত বাড়ি বা ভবনগুলি সংস্কারের জন্য তাঁরা চিন্তাভাবনা শুরু করেছেন বলে দাবি করেছেন পুরপ্রধান।

প্রাচীন এই শহরে পুরনো বাড়ির সংখ্যা নেহাত কম নয়। সংস্কারের অভাবে তার অনেকগুলিই এখন জীর্ণ। ইতিমধ্যেই বেশ কিছু পুরনো বাড়ি চলে গিয়েছে প্রোমোটারের হাতে। সেই সব বাড়ি ভেঙে উঠেছে আবাসন। পুরসভার হিসেবেই, গত কয়েক বছরে শহরে ৪০-৪২টি আবাসন হয়েছে। তার মধ্যে ৫০-৬০ বছরের পুরনো বাড়ি ভেঙে ১০-১২টি আবাসন হয়েছে। দেড়শো-দু’শো বছরের পুরনো বাড়ি ভেঙে আবাসন উঠেছে চারটি। তোলাফটকের মুখে কালুরায়তলাতেও কিছু দিন আগেই শতাধিক বছরের পুরনো একটি বাড়ি ভাঙা পড়েছে। কামারপাড়ার বাসিন্দা, তিয়াত্তরের অমলকিশোর মণ্ডলের কণ্ঠেও, “শহরটা এত দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে যে তাল মেলাতে পারছি না। ভাল লাগছে না।”

শহরের বহু জায়গাতেই নিকাশির এমন হাল। —নিজস্ব চিত্র।

প্রোমোটাররা দাবি করছেন, বড় বড় পুরনো বাড়িগুলি বাসিন্দারা অনেকেই আর খরচের কারণে রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারছেন না। তাই তাঁদের হাতে তুলে দিচ্ছেন। প্রোমোটারদের মধ্যে রাজীব রামপল গত কয়েক বছরে শহরে সাতটি আবাসন বাানিয়েছেন। তার মধ্যে একটি বানানো হয়েছে কনকশালিতে একটি ষাট বছরের পুরনো বাড়ি ভেঙে। তিনি বলেন, “এ শহরের রাস্তাঘাট সঙ্কীর্ণ। তাই ভিতরের দিকে সে ভাবে ফ্ল্যাট বানানো যায় না। বড় রাস্তার ধারের জমিতেই ফ্ল্যাট বানাতে হয়।”

কিন্তু পুর এলাকার অনেকেরই অভিযোগ, পুরোপুরি অপরিকল্পিত ভাবে শহর আবাসনে ঢাকছে। তাই নিকাশি সমস্যাও মিটছে না। রাজ্য সরকার নতুন নগরোন্নয়ন নীতিতে যে ভাবে পুর এলাকায় পুরনো বাড়ি ভেঙে গড়া এবং নতুন বাড়ি তৈরিতে ব্যাপক ছাড় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাতে শহরে প্রোমোটার-রাজ আরও বাড়ার আশঙ্কাও করেছেন কেউ কেউ।

কুটির মাঠ এলাকার বাসিন্দা, বছর পঁচাত্তরের মৃণাল মণ্ডল জন্ম থেকেই এ শহরের বাসিন্দা। তাঁর কথায়, “আগে শহরটাকে ভাল লাগত। এখন আবাসনের জঙ্গলে শহর ঘিঞ্জি হয়ে পড়েছে। ঐতিহ্য ক্রমশ নষ্ট হচ্ছে।” শিক্ষাবিদ সনৎ রায়চৌধুরী বলেন, “কী ডান, কী বাম কোনও আমলেই শহরকে পরিকল্পিত ভাবে গড়ে তোলার চেষ্টা হয়নি। ফলে, ইতিহাসের পাশাপাশি বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশও। মানুষের দুর্ভোগও বাড়ছে।”

তথ্য সহায়তা: তাপস ঘোষ।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy