Advertisement
১৯ নভেম্বর ২০২৪

সুখবরের অপেক্ষায় বিনিদ্র তিন পরিবার

কিছু দিন পর পরই তিনি বেরিয়ে পড়তেন পাহাড়ের সৌন্দর্যের টানে। ফেরার পরে ক্যামেরায় তোলা ছবি দেখিয়ে বেড়াতেন এখানে-সেখানে। প্রজেক্টর মেশিন নিয়ে পর্দায় সেই সব ছবি দেখানোর বন্দোবস্তও করতেন নিজের খরচে। স্বভাবতই, সাদা বরফে ঢাকা বিপদসঙ্কুল পাহাড়ি পথ, নদীনালা, সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রার নানা মূহূর্তের ছবি দেখতে প্রতি বারেই তাঁর ফেরার দিকে তাকিয়ে থাকেন পড়শি থেকে বন্ধুরাও। কিন্তু শুক্রবারেও তাঁর খোঁজ পাননি পরিবার-পরিজনেরা।

সুনীল সেন, ইন্দ্রজিত ঘোষ এবং তথাগত জানা।

সুনীল সেন, ইন্দ্রজিত ঘোষ এবং তথাগত জানা।

প্রকাশ পাল ও মনিরুল ইসলাম
শ্রীরামপুর ও ডোমজুড় শেষ আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০১৪ ০০:২৮
Share: Save:

কিছু দিন পর পরই তিনি বেরিয়ে পড়তেন পাহাড়ের সৌন্দর্যের টানে। ফেরার পরে ক্যামেরায় তোলা ছবি দেখিয়ে বেড়াতেন এখানে-সেখানে। প্রজেক্টর মেশিন নিয়ে পর্দায় সেই সব ছবি দেখানোর বন্দোবস্তও করতেন নিজের খরচে।

স্বভাবতই, সাদা বরফে ঢাকা বিপদসঙ্কুল পাহাড়ি পথ, নদীনালা, সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রার নানা মূহূর্তের ছবি দেখতে প্রতি বারেই তাঁর ফেরার দিকে তাকিয়ে থাকেন পড়শি থেকে বন্ধুরাও। কিন্তু শুক্রবারেও তাঁর খোঁজ পাননি পরিবার-পরিজনেরা।

নেপালে ট্রেকিং করতে গিয়ে তুষার ঝড়ের কবলে পড়েছিলেন বৈদ্যবাটির চতুষ্পাঠী লেনের তথাগত জানা। শেওড়াফুলির ইন্দ্রজিত্‌ ঘোষ নিখোঁজ। খোঁজ নেই হাওড়ার ডোমজুড়ের প্রাক্তন ব্যাঙ্ক অফিসার সুনীল সেনেরও। চরম উত্‌কণ্ঠায় দিন কাটছে পরিবারের। উদ্ধারকাজের তদারকির জন্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে আবেদন জানিয়েছেন তাঁরা। এ ছাড়া যোগাযোগ করা হয়েছে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের দফতরেও।

বেলুড়ের একটি পর্বতারোহী ক্লাব থেকে নেপালের অন্নপূর্ণা অঞ্চলে ট্রেকিংয়ে গিয়েছিলেন ওঁরা। দলে শেওড়াফুলি-বৈদ্যবাটির পাঁচ জন ছাড়াও, সুনীলবাবু এবং ব্যারাকপুরের এক যুবক ছিলেন। মঙ্গলবার মানাং জেলার ফু গ্রাম থেকে শিয়াং গ্রামে আসার পথে তুষারঝড়ের মুখে পড়েন তাঁরা। চার জনকে উদ্ধার করে নেপাল সেনা। নেপাল সরকার সূত্রে জানা গিয়েছে, নিখোঁজদের উদ্ধার করতে শুক্রবারেও হেলিকপ্টারে তল্লাশি চালানো হয়েছে। অরূপ রায়চৌধুরী নামে দমদমের এক অভিযাত্রীর দেহ উদ্ধার হয়েছে। তবে বাকিদের খোঁজ মেলেনি।

রাজ্যের যুবকল্যাণ দফতরের পর্বতারোহণ শাখার উপদেষ্টা উজ্জ্বল রায় জানান, নেপাল সরকারের তরফে পুরোদমে উদ্ধার কাজ চালানো হচ্ছে। কেন্দ্রীয় বিদেশ মন্ত্রকের মাধ্যমে ওই দেশের প্রশাসনের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছে রাজ্য সরকার। যুবকল্যাণ দফতরের তরফে একটি উদ্ধারকারী দল তৈরি রাখা হয়েছে। প্রয়োজন পড়লেই তাদের নেপালে পাঠানো হবে। আজ, শনিবার দফতরে বৈঠক করে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তথাগতর দাদা সিদ্ধার্থ অসহায় ভাবে বলেন, “আপাতত মুখ্যমন্ত্রীর দিকেই তাকিয়ে আছি।”

বৈদ্যবাটির তথাগত এলাকায় বেশি পরিচিত ‘গুরু’ নামে। ফটোগ্রাফির ব্যবসা ছাড়াও কাগজের এজেন্সি আছে। গত প্রায় ১৮ বছর ধরে ট্রেকিংয়ের নেশা। সন্দাকফু দিয়ে শুরু। তার পর বোরসু পাস, শতপন্থ, ভুইন্দার খাল, পারং লা, বাঘিনী বেস ক্যাম্প কোথায় না তিনি গিয়েছেন। তাঁর বাড়িতে স্ত্রী ছাড়াও আছে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া এক মাত্র মেয়ে। তথাগতর মায়ের বয়স আশিরও বেশি। রাত পর্যন্ত তাঁকে কিছু জানানো হয়নি। আত্মীয়েরা জানান, কিছু দিন আগেই তথাগত লাদাখে গিয়েছিলেন। মহালয়ার আগের দিন ফেরেন। তার পরেই নেপাল। আবার বেরিয়ে যান লক্ষ্মীপুজোর পরের দিনই। বন্ধুরা জানান, যাওয়ার আগে দুর্গাপুজোয় কম হইহুল্লোড় করেননি। চন্দননগরে লক্ষ্মীপ্রতিমা আনতেও গিয়েছিলেন। বন্ধু সুদীপ্ত হালদার এ দিন বলেন, “গুরু বলেছিল, আগামী বার ভাল ঢাকির খরচ ও-ই দেবে। সেই কথাটাই শুধু কানে বাজছে।”

শেওড়াফুলি হাটের সব্জির আড়ত্‌দার ইন্দ্রজিত্‌ ওরফে রাজার অবশ্য তথাগতের মতো ট্রেকিংয়ের অভ্যাস ছিল না। তাঁর জ্যাঠতুতো দাদা সৌমেন ঘোষ জানান, বছর দুয়েক আগে অমরনাথে গিয়ে শ্বাসকষ্টে ভুগেছিলেন তিনি। হাসপাতালেও ভর্তি হতে হয়। সে কারণে এ বার নেপালে যাওয়ার কথা শুনেই বারণ করেছিলেন বাড়ির লোকেরা। ইন্দ্রজিত্‌ শোনেননি। ছেলের নিখোঁজ হওয়ার খবর ইন্দ্রজিতের মা-বাবাকে বলা হয়নি। মা অবশ্য কোনও ভাবে বিষয়টি জেনে যান। তার পর থেকে শুধু ঠাকুরকে ডেকে চলেছেন। তাঁদের আত্মীয়, কংগ্রেস নেতা প্রীতম ঘোষ দিল্লিতে রাষ্ট্রপতির দফতরে বিষয়টি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “নেপালে ভারতীয় দূতাবাসের আধিকারিকেরা বিষয়টি দেখছেন। বিদেশ মন্ত্রকের অফিসারেরাও নিখোঁজদের খুঁজতে যথাসাধ্য করার আশ্বাস দিয়েছেন।”

বয়সকে পাত্তা না দিয়ে ট্রেকিংয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন ডোমজুড়ের ভাণ্ডারদহের হালদারপাড়ার বাসিন্দা সুনীল সেন। বছর দুয়েক আগেই একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে অবসর নিয়েছেন তিনি। গত ৮ অক্টোবর বৈদ্যবাটির দলটির সঙ্গেই তিনি রওনা দেন। গত ১৪ তারিখ রাতে শেষ বার তাঁর সঙ্গে বাড়ির লোকজনের কথা হয়েছিল। সে দিন তিনি জানিয়েছিলেন, নিরাপদেই আছেন। শুক্রবার সকালে কদমতলার বাসিন্দা সৌম্য মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে তাঁর নিখোঁজ হওয়ার খবর পান বাড়ির লোকেরা। সৌম্যবাবুও ট্রেক করেন। সুনীলবাবুর সঙ্গেও একাধিক বার গিয়েছেন। বিকেলে সুনীলবাবুর বাড়িতে বসে তিনি বলেন, “টিভিতে পর্বতারোহীদের নিখোঁজ হওয়ার খবর পেয়ে আমি প্রত্যেকের বাড়িতে টেলিফোন করে খবর দিয়েছি। ওঁদের সবাইকেই আমি চিনি।”

সুনীলবাবুরা দুই ভাই। এক দিদিও আছেন। তিন জনেই অকৃতদার। একই বাড়িতে থাকতেন। দাদা সুশীলবাবু বলেন, “ভাইয়ের খবর না পাওয়ায় উত্‌কণ্ঠায় আছি।” তাঁর আক্ষেপ, এখনও পর্যন্ত তাঁর নিখোঁজ পর্বতারোহীদের উদ্ধার করতে রাজ্য সরকারের তরফে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না, তা তাঁদের জানানো হয়নি। সরকারের তরফে কেউ যোগাযোগও করেননি।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy