পুইল্যা কিশোর ব্যায়াম সমিতি। এখান থেকেই উত্থান সুখেনের (উপরে)। নীচে, আন্দুল ব্যায়াম সমিতি। এখন ক্যারাটের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। ছবি: সুব্রত জানা।
ঘরের বাইরে সাইনবোর্ডে লেখা- ‘‘এখানে কোনও রাজনৈতিক আলোচনা চলবে না।’’
ভিতরে অবশ্য সশস্ত্র বিল্পবের প্রস্তুতি।
স্বাধীনতার আগে এভাবেই কাজ করত আন্দুলের বিভিন্ন ব্যায়াম সমিতি। এ শহরের ইতিহাস ও প্রবীণদের স্মৃতি অন্তত সেরকমই দাবি করছে। আন্দুল ব্যায়াম সমিতি, মৌড়ি স্পোর্টিং ক্লাব, মহিয়াড়ি মহাকালী ব্যায়াম সমিতি, দুইল্যা বিশ্বনাথ ব্যায়াম সমিতির কর্মকান্ড এখনও অগ্নিযুগের ইতিহাস বহন করছে। তবে পরিস্থিতি পাল্টেছে অনেকটাই। সময়ের দাবিতে এখন প্রায় সব ব্যায়াম সমিতিই আধুনিক মাল্টিজিম। যেখানে ভারোত্তোলন কিংবা নিখাদ মুগুর ভাঁজা যুবকের সংখ্যা ক্রমেই কমছে।
ভারোত্তোলনে আন্দুল বরাবরই বাংলার অন্যতম ‘সাপ্লাই লাইন’। যার সর্বশেষ উদাহরণ পুইল্যা কিশোর ব্যায়াম সমিতির সুখেন দে। ২০১৪ সালে গ্লাসগো কমনওয়েলথ গেমসে ভারোত্তোলনে সোনা পেয়েছিল সুখেন। জাতীয় ও রাজ্য স্তরেও আন্দুলের বিভিন্ন ব্যায়াম সমিতির ছেলেদের সাফল্য নজরকাড়া। ব্যায়াম সমিতিগুলির সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, ১৯৫৩ সালে প্রথম হাওড়া জেলা ভারোত্তোলন প্রতিযোগিতার আসর বসেছিল আন্দুল লক্ষ্মীকমল হাসপাতালের মাঠে। প্রথম স্থান পেয়েছিলেন মহিয়াড়ি মহাকালী ব্যায়াম সমিতির নবকুমার কোলে ।
২০০৭ সালে জেলা ভারোত্তোলনের আসর বসে দুইল্যা বিশ্বনাথ ব্যায়াম সমিতিতে। ২০১২ সালে রাজ্য ভারোত্তোলনে প্রতিযোগিতা হয় পুইল্যা কিশোর ব্যায়াম সমিতিতে। এই ব্যায়ামাগার সূত্রে জানা গেল, সংস্থার প্রতিষ্ঠা ১৯৬৪ সালে। ১০ বছরের খুদে থেকে ৭২ বছরের বৃদ্ধ, সকলকেই দেখা যায় এখানে। এঁদের অনেকেই ভারোত্তোলনে বাংলার হয়ে জাতীয় স্তরে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ভোর সাড়ে ৫টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চলে শরীরচর্চা। চাকরি পাওয়ার আগে পর্যন্ত এখানেই নিয়মিত অনুশীলন করতেন সুখেন।
‘আন্দুল মৌড়ির ইতিবৃত্ত’ থেকে জানা যায়, আন্দুলের সবচেয়ে পুরনো ব্যায়ামাগার আন্দুল ব্যায়াম সমিতি তৈরি হয় ১৯২১ সালে। স্থানীয় যুবক বলরাম ভট্টাচার্য এই সংস্থা তৈরি করেন। এখানে নিয়মিত লাঠিখেলা, কুস্তি, মুগুর ভাঁজার ব্যবস্থা ছিল। তালিম দেওয়া হত সশস্ত্র বিপ্লবের। আন্দুল ছাড়াও ঝোড়হাট, পুইল্যা, রাজগঞ্জ, খটিরবাজার, মৌড়ির যুবকেরা অনুশীলন করতে আসতেন। ইংরেজ পুলিশের চোখে ধুলো দিতে বাইরে সাইনবোর্ডে লেখা থাকত, ‘এখানে কোনও রাজনৈতিক আলোচনা করা চলবে না।’ সমিতির কর্তাদের দাবি, শুধু শরীরচর্চা নয়, আর্তের সেবাতেও সমিতির ভূমিকা রয়েছে। ১৩৫০ বঙ্গাব্দে দুর্ভিক্ষের সময় আন্দুল ব্যায়াম সমিতির প্রাঙ্গণে ক্ষুধাপীড়িতদের জন্য খোলা হয়েছিল লঙ্গরখানা।
ইতিহাসে নাম রয়েছে মহিয়াড়ি মহাকালী ব্যায়াম সমিতি ও দুইল্যা বিশ্বনাথ ব্যায়াম সমিতি-সহ আরও কয়েকটি ব্যায়ামাগারের। ১৯২৮ সালে স্থানীয় তালপুকুরধারের একটি বাড়িতে একটি ঘরে শুরু হয়েছিল মহাকালীর পথচলা। সংস্থার প্রাক্তন সভাপতি সুদর্শন মুখোপাধ্যায় জানান, প্রথমে বাঁশের বার ও একজোড়া মুগুর দিয়ে গ্রামের কয়েকজন যুবক শরীরচর্চা শুরু করেছিলেন। ১৯৩৯ -’৪০ সাল নাগাদ সংস্থাটি অন্য একটি বাড়িতে উঠে যায়। সেখানে লাঠিখেলা ও কুস্তি চর্চা শুরু হয়। সংস্থার নথি থেকে জানা যায় ১৯৪৫-’৪৬ সালে সারা বাংলা কুস্তি প্রতিযোগিতায় এই ক্লাবের প্রফুল্ল কোলে প্রথম স্থান পেয়েছিলেন। ১৯৪৬ সালে তৈরি হয়েছিল দুইল্যা বিশ্বনাথ ব্যায়াম সমিতি। সুখেন দে’র ক্লাব পুইল্যা কিশোর ব্যায়াম সমিতি তৈরি হয়েছিল ১৯৫৯ সালে।
তবে শরীরচর্চা ও ভারোত্তোলনে আন্দুলের সেই সোনালি অতীত এখনও অনেকটাই মলিন। বর্তমানে প্রায় সব কটি ব্যায়ামাগারেরই দখল নিয়েছে আধুনিক মাল্টিজিম। মহাকালী ব্যায়াম সমিতি-সহ কয়েকটি ক্লাবে ভারোত্তোলনের অনুশীলন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। মুগুর ভেঁজে শরীর চর্চাও প্রায় বন্ধ। দুইল্যা বিশ্বনাথ ব্যায়াম সমিতির কর্তা গৌতম দাসের আক্ষেপ, ‘‘ক্লাবে এখন কেউ মুগুর দিয়ে অনুশীলন করে না। সবাই জিম ব্যবহার করে। এই প্রজন্মের ছেলেরা কম পরিশ্রম করেই সুঠাম শরীর তৈরি করতে চাইছে। ক্লাবেরও টাকার প্রয়োজন। তাই তাদের জিমে প্রশিক্ষণে ভর্তি নেওয়া হচ্ছে। সাঁকরাইল স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক অশোক ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘আমরা চাই না সুখেন দে-ই আন্দুলের যুবকদের শরীরচর্চার সোনালি দিনের শেষ প্রতিনিধি হোক।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy