মহিলাদের বোঝাচ্ছেন সুমন্ত। নিজস্ব চিত্র
ফেসবুক প্রোফাইলে তাঁর ছবির পাশে লেখা ‘প্যাডম্যান’। চন্দননগরের সুভাষ পল্লির বাসিন্দা, সুমন্ত বিশ্বাস ভুগোলের গৃহশিক্ষক। তবে, নিজেকে আরও বেশি মেলে ধরেছেন ‘প্যাডম্যান’ হিসেবে। মেয়েদের স্যানিটারি ন্যাপকিন বিলি বা ব্যবহারের প্রয়োজন বোঝানো শুধু নয়, এ নিয়ে আবহমানকাল ধরে চলে আসা সংস্কারের মূলে কুঠারাঘাত করছেন তিনি। পাশে পেয়েছেন ছাত্রছাত্রীদের। দাবি তুলছেন, রেশনে স্যানিটারি ন্যাপকিন দেওয়া হোক। তা হলে, গরিব ঘরের মেয়েরা উপকৃত হবেন। এই দাবিতে প্রশাসনকে চিঠিও দিয়েছেন।
বছর পঁয়ত্রিশের সুমন্ত একাদশ থেকে এমএ ক্লাসের ভূগোল পড়ান। এক বছর অতিথি-শিক্ষক হিসেবে বেলুড়ের লালবাবা কলেজে পড়িয়েছেন। মহিলা, বিশেষত প্রান্তিক মেয়েদের সমস্যা তাঁকে বরাবরই ভাবিয়েছে। শুরুতে ঋতুকালীন পরিচ্ছন্নতা, স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার নিয়ে নিজের পরিচিত বা ছাত্রীদের বলা, লেখালেখি করতেন। ব্যাপক ভাবে নামেন ২০১৮ সালে। ওই বছরের ৫ সেপ্টেম্বর, শিক্ষক দিবসে এ ব্যাপারে সঙ্কল্প (সুমন্তের কথায়, ‘ভূ-সঙ্কল্প’) করেন।
সে বার মহালয়ার দিন বোলপুরের পলাশবনি গ্রামে যান পড়ুয়াদের নিয়ে। আদিবাসী মহিলাদের স্যানিটারি ন্যাপকিন বিলি করেন। তাঁদের বোঝান, মাসিক ঋতুস্রাব শরীরের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এ নিয়ে ছুৎমার্গ বা লুকোছাপা উচিত নয়। এর পর থেকে কখনও হুগলির সিঙ্গুর, হরিপাল বা পান্ডুয়ায়, পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ের মাথায় রুগরুঘুটু গ্রামে, সুন্দরবনের কুমিরমারি, চরঘেরি, বালি, পরশমণিতে, উত্তর ২৪ পরগনার হাবড়া বা বাঁকুড়ার কোতুলপুরে গিয়েছেন। সর্বত্র একই কাজ। সব জায়গাতেই এক দল ছাত্রছাত্রী সঙ্গে।
সুমন্ত বলেন, ‘‘অনেক জায়গাতেই মহি্লারা এখনও কাপড় ব্যবহার করেন। তবে, শখে নয়, অভাবে। কাউকে যাতে কাপড় ব্যবহার করতে না হয়, প্রশাসনের তা নিশ্চিত করা উচিত। রেশনে স্যানিটারি ন্যাপকিন দিলেই সমস্যা মিটবে।’’
মাস্টারমশাই মনে করেন, ঋতুস্রাবের সময় মেয়েদের নিয়ে ছুৎমার্গের অবসান ঘটানো উচিত। একই বক্তব্য তাঁর ছাত্রী মণি মান্না, ঋতু দাসদের। সাইকেলে প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে, গ্রামে শিবির করে এ নিয়ে সবাইকে বোঝানোর পালা চলে। সুমন্তের কথায়, ‘‘মাসিক স্রাবের সময় একটা অদ্ভুত গোপনীয়তা থাকে। আমার বাড়িতেও ছিল। এখন নেই। স্ত্রী-মা সবাইকে বুঝিয়েছি। স্ত্রী এখন ঋতুকালীন সময়েও পুজো দেয়। কুসংস্কার, গোঁড়ামিতে সমাজ ডুবে থাকবে কেন?’’ বর্তমান যুবসমাজের প্রতিনিধি মণি, ঋতুরাও বলছেন, ‘‘একটা বিজ্ঞানসম্মত বিষয় নিয়ে ভুল ভাবনা চলতে থাকা উচিত নয়। আমরা যেখানে যাচ্ছি, এটাই বোঝানোর চেষ্টা করছি। অনেকেই সচেতন হচ্ছেন। বোঝানোর পরে অজ পাড়াগাঁর মেয়েরাও অনেক সহজে বিষয়টি নিয়ে কথা বলছেন। তবে, আরও অনেক পথ যেতে হবে।’’
সুমন্তের একরত্তি মেয়ের জন্মদিন ১১ নভেম্বর। দিনটিকে তিনি ‘ঋতুকালীন কুসংস্কার দূরীকরণ দিবস’ হিসেবে পালন করেন। ভ্রাম্যমাণ ‘মেনস্ট্রুয়াল স্কুল’ও করেছেন। তাতে মেয়েদের শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া বোঝানো হয়। তাঁর কথায়, ‘‘ঋতুকালীন অপরিচ্ছন্নতায় মেয়েদের জরায়ু ক্যানসার হতে পারে। ঋতুস্রাবের সঙ্গে রক্তাল্পতারও সম্পর্ক আছে। তাই, সবাইকে সচেতন হতে হবে।’’
সিঙ্গুরের রেলবস্তিতে প্রতি মাসে জনা ৬০-৭০ মহিলাকে নিখরচায় স্যানিটারি ন্যাপকিন দেন সুমন্ত। লকডাউনে সাইকেল ছুটিয়ে গিয়েছেন। এই বস্তিকে ঋতুকালীন পরিচ্ছন্নতার আদর্শ এলাকা হিসেবে গড়ে তুলতে চান তিনি। প্রতি মাসে স্যানিটারি ন্যাপকিন কেনা-সহ অন্য খরচ আসে কোথা থেকে? সুমন্ত জানান, তাঁর গৃহশিক্ষকতার উপার্জন থেকেই অনেকটা আসে। ছাত্রছাত্রীরাও সাহায্য করেন।
শিক্ষক-ছাত্রছাত্রী উভয়েরই লক্ষ্য, মেয়েদের ঋতুকালীন পরিচ্ছন্নতার পরিবেশ আর কুসংস্কারমুক্ত সমাজ গড়ে তোলা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy