লাইনচ্যুত হাওড়া সিএসএমটি মুম্বই মেল। —ফাইল চিত্র।
ভোর তখন ৪টে। ঘুমচোখেই বাজতে থাকা ফোনটা তুলেছিলেন কসবা রথতলার বাসিন্দা অচিন্ত্য দাস। ফোনের ওপারে শাশুড়ি কাঁদতে কাঁদতে জানান, তাঁদের ট্রেন দুঘর্টনায় পড়েছে। সে সময়ে তাঁর স্বামী নিমাই প্রামাণিক ট্রেনের শৌচাগারে গিয়েছিলেন। দুর্ঘটনার পরে তিনি আর নিজের আসনে ফেরেননি। আতঙ্কিত শাশুড়িকে সে সময়ে অচিন্ত্য বোঝানোর চেষ্টা করেন, এই পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রাখতে। এর কিছুক্ষণ পরেই অবশ্য কোনও রকম ভাবে স্ত্রীর কাছে ফিরে আসেন বাকুলিয়া ধোবাপাড়া পঞ্চায়েতের গঙ্গাধরপুর গ্রামের বাসিন্দা নিমাই। বি-৪ কামরার যাত্রী নিমাই জানান, তিনি শৌচাগারে যাওয়ার সময়েই দুর্ঘটনার কবলে পড়ে ট্রেনটি। দরজা খুলে গিয়ে কামরার বাইরে ছিটকে পড়েন তিনি!
সোমবার ভোর পৌনে ৪টে নাগাদ দক্ষিণ-পূর্ব রেলের চক্রধরপুর শাখার বারাবাম্বু স্টেশনের কাছে লাইনচ্যুত হয় হাওড়া সিএসএমটি মুম্বই মেল। ওই ট্রেনের যাত্রী ছিলেন সস্ত্রীক নিমাই। দুঘর্টনার খবর পেয়ে এ দিন দুপুরে দাদা অজয় দাসকে সঙ্গে নিয়ে শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে পৌঁছতে হাওড়া স্টেশনে আসেন অচিন্ত্য। তিনি বলেন, ‘‘গত এক বছর ধরে টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালে শাশুড়ির ক্যানসারের চিকিৎসা চলছে। তাই তাঁরা হাওড়া থেকে মুম্বই মেলে মুম্বই যাচ্ছিলেন। ভোর ৪টে নাগাদ শাশুড়ির কাছে ট্রেন দুঘর্টনার খবর জানতে পেরে রেল কতৃর্পক্ষের সাহায্য চাই। এরপরে রেল সেখানে যাওয়ার সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে।’’ অচিন্ত্য জানান, ট্রেন থেকে পড়ে গিয়ে তাঁর শ্বশুর জখম হয়েছেন। তাঁকে ভর্তি করা হয়েছে চক্রধরপুর হাসপাতালে। সেখানেই যাচ্ছেন তাঁরা।
দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রেনে ছিলেন হুগলির আরও তিন জন। তাঁরা হলেন গুপ্তিপাড়া ১ পঞ্চায়েতের দাসপাড়ার যুবক বরুণ দাস, সিজা-কামালপুর পঞ্চায়েতের মুক্তকেশীতলার দম্পতি অঞ্জনা হালদার ও শ্যামাপ্রসাদ। রিনাও ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য মুম্বই যাচ্ছিলেন।
বরুণের কথায়, ‘‘আমি তখন জেগেই ছিলাম। হঠাৎ বগি কেঁপে উঠল। তারপরে হইচই শুরু হল। শুনলাম, বগি লাইনচ্যুত হয়েছে। কোনওক্রমে বেঁচেছি। বাড়ি ফিরছি। পরিজনেরা চিন্তায় রয়েছেন।’’ রিনা জানান, তাঁরা পিছনের বগিতে ছিলেন। ফলে তাঁদের কোনও ক্ষতি হয়। পরে অন্য ট্রেন ধরে মুম্বই রওনা দিয়েছেন তাঁরা।
এ দিন ট্রেন দুঘর্টনার খবর আসার পরেই রেলের পক্ষ থেকে হাওড়া স্টেশনের নতুন কমপ্লেক্সে হেল্পডেস্ক খোলা হয়। সকাল থেকেই সেখানে উপচে পড়ছে ভিড়। অনেকেই দিনভর দুর্ঘটনাগ্রস্ত পরিজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি বলে অভিযোগ করেন। দুর্ঘটনাগ্রস্ত যাত্রীদের হাওড়া ফিরিয়ে আনার জন্য রেলের পক্ষ থেকে কোনও ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়েছে কিনা, তা এ দিন বিকেল পর্যন্ত পরিজনেরা জানতে পারেননি।
এ দিন সকাল থেকে ওই ট্রেনের বি-৫ কামরার যাত্রী, বর্ধমানের বাসিন্দা আবুল মল্লিকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না তাঁর দাদা মনিরুল। এ দিন হাওড়া স্টেশনের হেল্পডেস্কে খোঁজ নিতে আসেন তিনি। একই পরিস্থিতি গুপ্তিপাড়ার বাসিন্দা গৌরাঙ্গ দাসের। বি-২ কামরার ৬৯ নম্বর আসনের যাত্রী ছিলেন তাঁর ভাই। দুর্ঘটনায় তিনি সামান্য আহত হয়েছেন। কিন্তু ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে গৌরাঙ্গ এ দিন হেল্পডেস্কের শরণাপন্ন হন। ভাই কোথায়, কী অবস্থায় আছেন বা তাঁকে কোনও উদ্ধারকারী ট্রেনে করে হাওড়ায় ফেরানো হচ্ছে কিনা, তা জানতে চান গৌরাঙ্গ। তবে হাওড়া স্টেশনে আসা উদ্বিগ্ন পরিজনদের অভিযোগ, দক্ষিণ-পূর্ব রেলের পক্ষ থেকে তাঁদের কোনও প্রশ্নেরই উত্তর যেমন দেওয়া হয়নি, তেমনই পরিজনদের বাড়তি খবর দেওয়ার ব্যাপারেও রেলের তরফে কোনও উৎসাহ দেখা যায়নি।
এ প্রসঙ্গে রেলের এক পদস্থ কর্তা বলেন, ‘‘আসলে অধিকাংশ যাত্রীকে আজ সকালেই একটি উদ্ধারকারী ট্রেনে করে মুম্বই রওনা করিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাকিদের বাসে করে চক্রধরপুর বা টাটা পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, ট্রেন ধরে হাওড়ায় ফেরার জন্য। তাই হয় তো তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy