পরিবারের চার জনকে খুনে অভিযুক্ত স্বামী-স্ত্রী গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
পরিবারের চার জনকে নৃশংস ভাবে খুন করে তিনি অনুতপ্ত! পুলিশি হেফাজতে থাকা পল্লবী ঘোষ সম্পর্কে এমনটাই জানিয়েছেন তদন্তকারীদের একটি সূত্র। তাঁদের কাছে পল্লবী জানিয়েছেন, শ্বশুরবাড়িতে দীর্ঘ দিন ধরেই নির্যাতনের শিকার তিনি। ভাসুর প্রায়শই কুপ্রস্তাব দিতেন তাঁকে। পল্লবী তদন্তকারীদের কাছে দাবি করেছেন, সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ বাধায় সেই সব রাগ একত্রিত হয়ে প্রবল আক্রোশে স্বামীর সঙ্গে মিলে খুন করেছেন তিনি। একই সঙ্গে পল্লবীর দাবি, তিনি অনুতপ্ত।
বুধবার রাতে ওই ঘটনার পর পল্লবীকে গ্রেফতার করা হলেও তাঁর স্বামী দেবরাজ এখনও পলাতক। তাঁর খোঁজে তল্লাশি চলছে। হাওড়ার পঞ্চাননতলা রোড সংলগ্ন এম সি ঘোষ লেনের বাড়িতে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে ফরেন্সিক দল আসে। নমুনা সংগ্রহ করে ঘটনার পুনর্নির্মাণও করা হয়। ঠিক আগের রাতেই (বুধবার) ওই বাড়ির একতলার দালান ও দেওয়ালে চাপ চাপ রক্ত দেখে আঁতকে উঠেছিলেন পড়শিরা। হাওড়া সিটি পুলিশের এসিপি (সেন্ট্রাল) মৃত্যুঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ পুলিশের পদস্থ কর্তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন নৃশংসতার ওই দৃশ্য দেখে। তার কিছু ক্ষণ আগেই মা মাধবী ঘোষ (৫৬), দাদা দেবাশিস ঘোষ (৩৬) ও তাঁর স্ত্রী রেখা ঘোষ (৩০) এবং তেরো বছরের ভাইঝি তিয়াসা ঘোষকে ওই বাড়িতে কুপিয়ে খুন করেন দেবাশিসের ছোট ভাই দেবরাজ ও তাঁর স্ত্রী পল্লবী। কোনও মতে পালিয়ে প্রাণে বাঁচেন দেবরাজ-দেবাশিসের বাবা শিশির ঘোষ। রাতেই চার জনের দেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়। পুলিশ সূত্রে খবর, দেবাশিসের যৌনাঙ্গ কেটে নেওয়ার ঘটনাই প্রমাণ করে ঘটনার সময় কতটা ‘হিংস্র’ ছিলেন দেবরাজ-পল্লবী।
তদন্তকারীদের একাংশের দাবি, ক্ষতবিক্ষত চার দেহ দেখে তাঁদের মনে হয়েছে, মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত চলেছে ওই হত্যালীলা। তদন্তকারীদের সূত্রে জানা গিয়েছে, বুধবার রাতের ঘটনা পল্লবীর মাথায় ‘গেঁথে’ গিয়েছে। স্বামী ও তাঁর ‘হিংস্রতা’র স্মৃতি ফিরলেই কেঁদে ফেলছেন তিনি। জেরায় তদন্তকারীদের পল্লবী জানান, প্রেম করে দেবরাজের সঙ্গে বিয়ে হওয়ায় তাঁকে শ্বশুরবাড়িতে কখনওই মেনে নেওয়া হয়নি। তিনি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বিয়ের পর থেকেই। শাশুড়ি মাধবী ও ভাসুর দেবাশিস চুলের মুঠি ধরে মারধর, গালিগালাজ করতেন। বাদ যায়নি তাঁর ছোট্ট ছেলেও।
ধৃত পল্লবী তদন্তকারীদের জানিয়েছেন, বিয়ের পর থেকেই ভাসুর দেবাশিস তাঁকে কুপ্রস্তাব দিতেন। বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক চাইতেন তিনি। কয়েক বার শ্লীলতাহানিরও শিকার হন। পল্লবীর অভিযোগ, থানায় অভিযোগ দায়ের করেও কোনও কাজ হয়নি। ঘটনার রাতেও নাকি দু’হাজার টাকা দিতে চেয়ে নিজের ঘরেও ডেকেছিলেন দেবাশিস! বহু দিন ধরে এই ঘটনা ঘটতে থাকায় মানসিক ভাবেও অসুস্থ এবং অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা দেখা দেয় তাঁর শরীরে। অনেক রকমের ওষুধ খেতে হত তাঁকে।
দেবাশিস-দেবরাজদের বাড়ির পাশেই থাকেন তাঁদের জেঠতুতো দাদা সুব্রত ঘোষ। চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে তাঁরা ওই বাড়িতে গিয়ে দেখেন দেবরাজের হাতে কাটারি আর পল্লবীর হাতে ছুরি। ঘটনার পর সেখানে গিয়ে দু’টি ধারালো অস্ত্রই উদ্ধার করেছে পুলিশ। তদন্তকারীদের পল্লবী জানান, কয়েক দিন আগে ওই কাটারিতে শান দিয়ে এনেছিলেন তিনি। কিন্তু তা দিয়ে খুন করার কোনও পরিকল্পনা তাঁর ছিল না। ভয় দেখানোই উদ্দেশ্য ছিল। তার কারণ শুধু শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার বা ভাসুরের ‘কুনজর’ই নয়, সম্পত্তি নিয়েও অনেক দিন ধরে দেবরাজ-দেবাশিসের মধ্যে ঝামেলা চলছিল। হুগলির ভদ্রেশ্বরে শিশিরের একটি সম্পত্তি রয়েছে। সেখানেই সপরিবার থাকেন দেবাশিস। মাঝেমাঝেই পরিবার নিয়ে তিনি হাওড়ার বাড়িতে আসেন। ঘটনার কয়েক দিন আগে থেকেই সেখানে ছিলেন তাঁরা। পল্লবীর দাবি, দেবাশিস আর তাঁর পরিবার যখনই হাওড়ার বাড়িতে আসতেন, তখনই ঝামেলা হত। বুধবার রাতেও একই ভাবে দুই ভাইয়ের পরিবারের মধ্যে অশান্তি-মারপিট শুরু হয়। সেই সময় ওই কাটারি দেখিয়েই দেবরাজ ও তাঁর স্ত্রীকে ভয় দেখাতে চেয়েছিলেন তিনি। তদন্তকারীদের একটি সূত্র জানিয়েছেন, জেরার সময় এই কথাগুলি বলতে গিয়ে দৃশ্যত ‘ভীত’, ‘সন্ত্রস্ত’ দেখিয়েছে পল্লবীকে।
হাওড়া সিটি পুলিশের এক কর্তা জানান, পল্লবীর বয়ান রেকর্ড করা হচ্ছে। তিনি আদৌ সত্যিই বলছেন কি না, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। পল্লবীর বয়ানে যে খানিক অসঙ্গতি রয়েছে, তা-ও স্বীকার করছেন তদন্তকারীদের একাংশ। কারণ, যদি শাশুড়ি ও ভাসুরদের শুধুই ভয় দেখানোর উদ্দেশ্য থাকত, তা হলে কাটারিতে শান দেওয়ার দরকার কী ছিল? এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে পুলিশ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy