প্রতীকী ছবি।
নগরায়ণের চাপে গত ৫০ বছরে হাওড়ার আকাশ চুরি গিয়েছে, আর বাতাসটা হয়েছে ডাকাতি। ‘কুলি টাউন’-এর তকমা নিয়ে ধুঁকে চলেছে হাওড়া শহর।
ভৌগোলিক দিক থেকে পশ্চিমমুখী ঢালের শহর হাওড়া, পূর্বের তুলনায় পশ্চিমে প্রায় ১০ ফুট নিচু। পূর্ব কলকাতা জলাভূমির মতো বড় কিছু না থাকলেও তিনটে বড় জলাশয় ছিল পশ্চিমে— ডুমুরজলা, শানপুর জলা এবং পদ্মপুকুর জলা। নামেই রয়েছে এদের পরিচয়। শানপুর এবং ডুমুরজলা বহু কাল গত হয়েছে। পদ্মপুকুরের কিছুটা এখনও বেঁচে। সাঁতরাগাছি থেকে শালিমারের রেললাইন শহরের দক্ষিণমুখী ঢালের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। উন্নয়নের নামে প্রাকৃতিক নর্দমার বারোটা বাজিয়ে দেওয়া হয়েছে। ১৯৯৭ সালে হাই কোর্টে পেশ করা তথ্য অনুসারে, মধ্য এবং দক্ষিণ হাওড়ায় দুশোর বেশি পুকুর এবং জলাশয় ছিল। বুজতে বুজতে এখন ৫০টিও বেঁচে নেই।
১৯৭২ সালের হিসাব অনুযায়ী, হাওড়া শহরে খোলা নর্দমা ছিল প্রায় চারশো কিলোমিটার। পরে তা বেড়েছে। রাজনৈতিক কারণে বালি পুরসভাকে হাওড়ার সঙ্গে যোগ করায় বেড়েছে পুর এলাকাও। সত্তরের দশকে এই শহরে ভূগর্ভস্থ পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থার সূচনা হয়। বেতড়ের আরুপাড়ায় হয় নিকাশি জল পরিশোধনের প্রথম প্লান্ট। বসল পাইপলাইন। কিন্তু ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত বাড়িতে সংযোগ পৌঁছল না। এ দিকে ১০/১২ বছর কাজ না করায় প্লান্টটি অকেজো হয়ে গেল। মধ্যে কিছু হাতবদল ঘটল। প্রথমে হাওড়া উন্নয়ন সংস্থা। এর পরে কেএমডব্লিউএসএ-র হাত ঘুরে ভূগর্ভস্থ পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থাকে আধমরা করে হাওড়া পুরসভাকে দেওয়া হল। খোলা আর ঢাকা নর্দমার গতি রুদ্ধ হয়ে জল জমতে শুরু করল। তখন আবার পাইপ ফুটো করে বা নর্দমা কেটে খোলা ও ভূগর্ভস্থ নর্দমাকে অনেক জায়গায় জুড়েও দেওয়া হল! উভয় নর্দমার জল বেরোনোর পথ পেল না।
এ দিকে মধ্য ও দক্ষিণ হাওড়ার খোলা নর্দমার জল এবং বেতড়ের ট্রিটমেন্ট প্লান্টের বর্জ্য শোধিত হয়ে যে ড্রেনেজ ক্যানাল দিয়ে যেত, সেটিও ঢেকে দেওয়া হল। কোনও ভাবেই সেখানে পাঁক পরিষ্কারের ব্যবস্থা রাখা হল না। কলকাতা পুর এলাকার ভূগর্ভস্থ নর্দমার জল শেষ পর্যায়ে উন্মুক্ত খাল দিয়ে প্রবাহিত হয়। হাওড়া তার উল্টো পথে হাঁটল। কয়েকশো কিলোমিটার খোলা নর্দমা দিয়ে জল এসে শেষের ৭/৮ কিলোমিটার ঢেকে দেওয়া হল। আর পুরসভা ওই ড্রেনেজ ক্যানালের উপরেই বাণিজ্য কেন্দ্র করল! নর্দমা তার পথ হারাল।
বিগত ৩০/৩৫ বছরে রাস্তা উঁচু হওয়ায় জমা জল গৃহস্থের বাড়ির উঠোন পেরিয়ে রান্নাঘরে হানা দিচ্ছে। মাথাব্যথা বাড়াচ্ছে হাওড়ার যত্রতত্র ফেলা ময়লাও। কঠিন বর্জ্য এবং বৃষ্টির জলে নর্দমার পাঁক, দুইয়ের মিশ্রণ কতটা স্বাস্থ্যহানি করছে, সেই হিসাব কেউ রাখেন না। পাথরকুচি, খোয়া বেরোনো পথ দিয়ে শুকনো সময়ে ভারী গাড়ি যখনই চলছে, পাথরের গুঁড়ো আর কাদায় ধুলোর ঝড় উঠছে। বেশ কিছু বড় নর্দমার তো জঞ্জাল পরিষ্কারের সুযোগই নেই। যেমন, টিকিয়াপাড়া স্টেশনের পশ্চিমের যে বড় নর্দমা বেনারস রোডের দিকে গিয়েছে, দু’পাশের নির্মাণ আটকে রেখেছে তার অনেকটা অংশ পরিষ্কারের সুযোগ।
দীর্ঘ সময়ে কোনও রাজনৈতিক নেতৃত্বই হাওড়ার এই সমস্যার কেন্দ্রে পৌঁছতে পারেননি। নিকাশির মাস্টার প্ল্যান হয়নি। তবে এখনই একটা কাজ আবশ্যিক। হাওড়ার খোলা ও ঢাকা নর্দমা এবং পচা খাল থেকে লক্ষ লক্ষ টন পাঁক তুলে ফেলতে হবে। কিন্তু রাজনীতি এবং দুর্নীতির জাঁতাকলে সেই কাজ কি সম্ভব?
(পরিবেশকর্মী)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy