ব্যান্ডেল স্টেশনের ভিতর। ছবি: তাপস ঘোষ
সকালে খবরের কাগজে দেখলাম, ব্যান্ডেল স্টেশন ঢেলে সাজা হবে। মনে ভেসে উঠল আমার ছাত্রবেলা। আমার বাড়ি ব্যান্ডেল-কাটোয়া শাখার জিরাটে। ছেলেবেলায় স্টিম ইঞ্জিনের কু-ঝিকঝিক পেরিয়ে নয়ের দশকে যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি, এই ব্যান্ডেলে এসে আজিমগঞ্জ প্যাসেঞ্জার ইলেকট্রিক ইঞ্জিন পাল্টে ডিজ়েল ইঞ্জিনে যুক্ত হোত। ২০ থেকে ২৫ মিনিট থেমে ছুটত গাড়ি।
কত কথা মনে পড়ছে! সেই সময় প্ল্যাটফর্মে বিস্তৃত শেড ছিল না। ছিল, ছোট। ১-এ প্ল্যাটফর্মে (এখন ১ এবং ২) শেড ছিল না। শিমুল, শিরীষ, রাধাচূড়া ঘিরে রাখত ব্যান্ডেল স্টেশনকে। ট্রেনের অপেক্ষায় সেই গাছের ছায়ায় বসে গল্পগুজব করে বা উপন্যাস, কবিতা পড়ে কত সময় কেটেছে আমাদের।
মনে আছে, ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্মের শিরীষ গাছের তলায় বসে আমি শেষ করেছিলাম ‘বনলতা সেন’। সন্ধ্যার মুখে ফেরার সময় দেখতাম, প্রচুর পাখির ঠিকানা সে সব গাছ। তাঁদের কিচিরমিচিরে স্টেশন ভরে উঠত। ব্যান্ডেল স্টেশন আমার কাছে সুর করে চা বিক্রেতার বিকিকিনিও বটে। স্টেশনের প্রশাসনিক ভবন তখন এত বড় ছিল না। ছোট এবং কার্যত ম্যাড়মেড়ে ছিল সেই ভবন।
এ বার আসা যাক এ তল্লাটে রেলপথের গোড়ার কথায়। গঙ্গার তীর ঘেঁষে রেলপথ স্থাপনের জন্য কলকাতার টাউন হলে সভা হয়েছিল। তোলা হয়েছিল টাকা। কিন্তু জমি মিলবে কী ভাবে? ১৮৫০ সালে ডিসেম্বর মাসে রেলের জন্য জমি সংগ্রহের আইন চালু হল। স্টিফেনসন সাহেবের নেতৃত্বে বছর তিনেকের মধ্যে হাওড়া থেকে পান্ডুয়া পর্যন্ত জমিতে রেলপথ বসল। বিলেত থেকে একটি রেলগাড়ি জাহাজে এল কলকাতায়। ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে-র প্রধান ইঞ্জিনিয়ার হজসন সাহেব কলকাতায় নিজের নকশামাফিক গাডি তত দিনে বানিয়ে ফেলেছিলেন। বিলেত থেকে ইঞ্জিন এল।
১৮৫৪ সালের ১৫ অগস্ট হাওড়া থেকে হুগলিতে রেলের চাকা গড়াল। থামল বালি, শ্রীরামপুর, চন্দননগর হয়ে হুগলি। হাওড়া থেকে সাড়ে ৮টায় ছেড়ে হুগলিতে ট্রেন এল বেলা সাড়ে ১০টা নাগাদ। হুগলির ব্যবসায়ী রূপচাঁদ ঘোষ ছিলেন প্রথম যাত্রী। বিশ্বাসই হল না, মাত্র দু’ঘন্টায় হুগলি পৌঁছ গেলেন কী ভাবে? ট্রেনটি চালিয়ে এনেছিলেন হুগলির জামাই যদু মাস্টার (ঘোষ)। যাঁকে নিয়ে সেই বিখ্যাত ছড়া, ‘আইকম বাইকম তাড়াতাড়ি / যদু মাস্টার শ্বশুরবাড়ি / রেল কম ঝমাঝম / পা পিছলে আলুর দম’।
এর দু’মাস পরেই ব্যান্ডেল হয়ে পান্ডুয়া পর্যন্ত ট্রেন চালু হয়। ক্রমে বর্ধমান পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। তার পরেই কাটোয়ার দিকে লাইন পাতা হল। ব্যান্ডেলের সঙ্গে জুড়ল নৈহাটিও। বর্ধমান, কাটোয়া, নৈহাটির মাঝে সেতুবন্ধক হল ব্যান্ডেল। বাংলারপ্রথম জংশন স্টেশন হল ব্যান্ডেল। এখানে সে সময় স্টেশন মাস্টার ছিলেন জে ককরা।
ব্যান্ডেলের সঙ্গে জড়িয়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নাম। শেষ জীবনে এই স্টেশন হয়ে দেবানন্দপুরে যাতায়াত করেছেন কথাশিল্পী। ব্যান্ডেল স্টেশনে এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। শোনা যায়, বিশ্বভারতীর ছাত্রছাত্রীরা কলাভবনের তৎকালীন অধ্যক্ষ নন্দলাল বসুর সঙ্গে আঁকার ক্লাস করতে হংসেশ্বরী মন্দিরে যান ব্যান্ডেল স্টেশনে নেমে। সেই দলে ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। তখন তিনি প্রধানমন্ত্রী নন, বিশ্বভারতীর ছাত্রী।
চমকপ্রদ তথ্য আরও আছে। প্রাক্তন রেলমন্ত্রী গনিখান চৌধুরীর কাছে এক বার ব্যান্ডেল স্টেশনে মানুষজন একটি বাড়তি প্ল্যাটফর্মের আর্জি জানান। গনিখান নির্দেশ দেন এক সপ্তাহের মধ্যেই প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে। হলও তাই। ১-এ প্ল্যাটফর্ম তৈরি হল সাত দিনের মধ্যে। এখন এটি ২ নম্বর প্ল্যাটফর্ম।
আমার পুরনো, চেনা স্টেশন এখন অনেকটাই বদলে গিয়েছে। স্টেশনের দেওয়ালে এখন নানা রকম ছবির সৌন্দর্য। শরৎচন্দ্র, ব্যান্ডেল চার্চ প্রভৃতি ঐতিহ্যের স্মারকও দেওয়ালে শোভা পাচ্ছে কারুকাজে। এই স্টেশন আরও বদলে যাবে। অনেক আলোকময়, ঝাঁ-চকচকে হবে শুনছি। নতুন রূপে গড়ে তোলার প্রয়াস অত্যন্ত আনন্দের।
পূর্ব রেলকে একটাই অনুরোধ, প্রথম ট্রেনের ইঞ্জিনের যে রেপ্লিকাটি এখনও স্টেশন চত্ত্বরে রয়ে গিয়েছে, সেটি যেন থেকে যায়। এটি স্টেশনের অতীতকে মনে করিয়ে দেয়।
(আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy