শিক্ষিত যুবক চা বিক্রেতা। পান্ডুয়া
দক্ষিণ ২৪ পরগনার সাগরের খানসাহেব গ্রামের বাসিন্দা লক্ষ্মণ মণ্ডল এমএ পাশ। বিএড করেছেন। সরকারি চাকরির জন্য বহু পরীক্ষা দিয়েও হাত খালি। উচ্চ প্রাথমিকের পরীক্ষায় পাশ করেও চাকরি জোটেনি। আপাতত দিনমজুরি করে সংসার চালাচ্ছেন। সেই সঙ্গে প্রাইভেট টিউশন পড়িয়ে কিছু টাকা পান।
লক্ষ্মণ বলেন, ‘‘এমএ-বিএড করেও চাকরি পেলাম না। পরীক্ষায় পাশ করেও বসে আছি। তবে সংসার তো চালাতে হবে। তাই পানের বরজে কাজ করি। ছেলেমেয়েদের পড়াই। আমাদের রাজ্যের যা অবস্থা, কবে সরকারি চাকরি পাব, তার ঠিক নেই।’’ লক্ষ্মণের আক্ষেপ, ‘‘যদ্দিনে ডাক আসবে, তখন হয় তো চাকরিতে জয়েন করার বয়সই পেরিয়ে গিয়েছে!’’কাকদ্বীপের বসন্তপুর এলাকার বাসিন্দা সৌমেন দাস ২০১২ সালে স্নাতক হয়েছেন। একাধিক পরীক্ষায় বসেন। চাকরি জোটেনি। এখন প্রাইভেট টিউশন পড়িয়ে সংসার চালান। সৌমেনের কথায়, ‘‘শুনছি চাকরি পেতে হলে না কি টাকা দিতে হয়। আমার সে ক্ষমতা নেই। তাই হয় তো চাকরি পাইনি। বাধ্য হয়ে টিউশন পড়াই। মাঝে মধ্যে ছোটখাট সংস্থায় কিছু কাজ করি।’’রাজ্যের নানা প্রান্তেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে এমন বহু উদাহরণ।
বিএ পাশ করে সাত-আট বছর ধরে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের একাধিক চাকরির পরীক্ষায় বসেছিলেন উত্তর ২৪ পরগনার গাইঘাটার ফুলসরার বাসিন্দা স্বপন ঘোষ। এক সময়ে ছাত্র পড়াতেন। তেমন উপার্জন হত না। চাঁদপাড়া বাজারে লটারির দোকানে কাজ করেছেন কিছু দিন।কখনও ঘুরে ঘুরে কাপড় বিক্রিও করেছেন। গত দশ বছর ধরে দিনমজুরি করে সংসার সামলাচ্ছেন। স্বপনের কথায়, "বনগাঁ পুরসভার নিয়োগ পরীক্ষা এবং ইন্টারভিউ ভাল হয়েছিল।ভেবেছিলাম, কাজটা হবে। হল না। এখন চারিদিকে পুরসভায় নিয়োগ নিয়েও দুর্নীতির অভিযোগ শুনতে পাই। হয় তো সে কারণেই ভাল পরীক্ষা দিয়েও কাজ পাইনি।"
স্বপন জানালেন, মাসে ৬-৭ হাজার টাকা রোজগার। এ দিকে, একমাত্র ছেলে দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত। তার পিছনেও বহু টাকা খরচ হয়েছে। প্রতি দিন ৫০০ টাকার ওষুধ লাগে। বাজারে বহু ধারদেনা। স্বপন বলেন, ‘‘একটা সরকারি কাজ যদি মিলত, তা হলে হয় তো রোদে পুড়ে দিনমজুরি করতে হত না।"
ইতিহাসে এমএ করেছিলেন হিঙ্গলগঞ্জ ব্লকের গোবিন্দকাটির বাসিন্দা সুভাষচন্দ্র দাস। বিএড ডিগ্রিও হয়েছে। চাকরির পরীক্ষায় বসে লাভ হয়নি। বহু বছর ধরে জুতো সেলাই করেন তিনি। পাশাপাশি, ছোটদের পড়ান। সব মিলিয়ে মাসে হাজার পাঁচেক টাকা রোজগার। বছর চুয়াল্লিশের সুভাষ জানান, অভাবের সংসারে বিভিন্ন মানুষের সাহায্য নিয়ে পড়াশোনা চালিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, চাকরি পেয়ে অনেকের স্বপ্ন পূরণ করতে পারবেন। ২০১৫ সালের শেষ দিকে উচ্চ প্রাথমিকের পরীক্ষা হয়েছিল, তাতে উত্তীর্ণ হন। ইন্টারভিউয়ে ডাক পান। প্যানেলে নাম উঠে। কিন্তু সেই প্যানেলের উপরে মামলা হওয়ায় হাই কোর্টে মামলা চলছে। সুভাষের এখনও ক্ষীণ আশা আছে, হয় তো চাকরির ডাক আসবে। তবে তখন চাকরিতে যোগ দেওয়ার বয়স থাকবে কি না, সেটাই ভাবায়।
সুভাষ জানালেন, চাকরি পেয়ে যাবেন এই আশায় ২০১০ সালে বিয়ে করেছিলেন। আর্থিক সমস্যা থাকায় সংসারে অশান্তি শুরু হয়। স্ত্রী বছর তিনেক বাদে চলে যান। মায়ের অসুখের সময়ে চিকিৎসার খরচ সংগ্রহ করতে পারেননি সুভাষ। মারা গিয়েছেন মা। সেই কষ্ট কুড়ে কুড়ে খায়। এখন ভাইয়ের সংসারে থাকেন সুভাষ।
হুগলির গোঘাটের কামারপুকুরের বাসিন্দা অমিতকুমার সেনের বয়স তেত্রিশ। বাংলায় এমএ করেছেন। বিএডের ডিগ্রি আছে। জানালেন, ২০১২ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত দু’বার উচ্চ প্রাথমিক এবং এক বার প্রাথমিকের পরীক্ষায় পাশ করেছিলেন। চাকরি মেলেনি। মামাদের সহায়তায় বছরখানেক হল কামারপুকুর হাটে পাইকারি এবং খুচরো আনাজ ব্যবসা শুরু করেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘চাকরির অপেক্ষায় অনেকগুলো বছর নষ্ট করেছি। এখন আফসোস হয়। কোনও কাজই ছোট নয়, সেটা উপলব্ধি করতে পেরেছি।’’
কুড়ি বছর ধরে বিভিন্ন অফিসে ঘুরে ধূপ বিক্রি করেন সরস্বতী ঘোষ। হাওড়ার অফিসপাড়ায় নিয়মিত দেখা মেলে তাঁর। থাকেন হুগলির হিন্দমোটরের কাছাড়িপাড়ায়। ১৯৯৮ সালে উত্তরপাড়ার প্যারীমোহন কলেজ থেকে বিএ পাশ করেছিলেন। দীর্ঘ দিন ধরে চেষ্টা করেও সরকারি চাকরি মেলেনি। পাড়ার এক পরিচিতের সাহায্যে যোগাযোগ হয় শেওড়াফুলির ধূপকাঠির স্টকিস্টের সঙ্গে। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন তিনি।
ধূপ বিক্রির যৎসামান্য রোজগারেই চলত মা-মেয়ের সংসার। মা মারা গিয়েছেন। এখন একাই থাকেন। যে অফিস পাড়ায় কাঁধে ব্যাগ নিয়ে কোনও এক চেয়ারে বসে ফাইলপত্র সাজিয়ে চাকরি করবেন ভেবেছিলেন, সেই অফিস পাড়ায় রোজ পৌঁছে যান ধূপকঠির ব্যাগ নিয়ে। মাসেরশেষে আয় হয় হাজার চারেক টাকা। নিজে শরীর ভাল নয়। অনেকটাটাকাই বেরিয়ে যায় ওষুধপত্রের পিছনে।
পান্ডুয়ার জয়পুর রেলগেটের কাছে ছোট্ট চায়ের দোকান চালান সুভাষ ঘোষ। খন্যান ইটাচুনা বিজয় নারায়ণ মহাবিদ্যালয় থেকে ২০০৪ সালে বিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক হয়েছিলেন। বহু চাকরির পরীক্ষায় বসেও সাফল্য অধরাই থেকে গিয়েছে। আপাতত চায়ের দোকানই তাঁর সম্বল।উচ্চশিক্ষা লাভের পরেও মন মতো চাকরি পেলেন না যাঁরা, তাঁরা যে যার মতো করে জীবনের যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন।
জীবন তাঁদের শিখিয়েছে, কোনও কাজই ছোট নয়। টিঁকে থাকার লড়াইটা চালিয়ে যাওয়াইআসল কথা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy