হেনস্থার শিকার একই পরিবারের তিন সদস্য। বুধবার, জগদীশপুর ফাঁড়িতে। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার।
একটি বাড়ির বারান্দায় পঞ্চাশোর্ধ্বা এক মহিলার চুল কাঁচি দিয়ে কেটে দিচ্ছেন স্যান্ডো গেঞ্জি পরিহিত, গলায় গামছা দেওয়া এক ব্যক্তি। খাবলা খাবলা করে ওই মহিলার চুল কেটে দেওয়ার পরে এক-এক করে নেড়া করে দেওয়া হল তাঁর স্বামী ও কিশোর পুত্রকে। এই দৃশ্য দেখতে বাড়ির উল্টো দিকে জড়ো হয়েছেন কয়েকশো বাসিন্দা। প্রতিবাদ করা তো দূর, বরং তাঁদের তরফ থেকে আসছে কটূক্তি ও হুমকি।
দিনকয়েক আগে সমাজমাধ্যমে এই ভিডিয়ো (সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার) ভাইরাল হওয়ার পরে বুধবার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। জানা যায়, প্রায় ২৫ দিন আগে হাওড়ার উত্তর কোলোরার চাঁদনি মোড়ে এক ব্যবসায়ীর বাড়ি থেকে ২০ লক্ষ টাকা চুরির ঘটনা ঘটে। নিজামুদ্দিন নস্কর নামে ওই বস্ত্র ব্যবসায়ী এবং তাঁর পরিবারের লোকজন অভিযোগ করেন, তাঁদের বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করতেন যে তরুণী, তিনিই বাড়িতে রাখা ১০ লক্ষ টাকা চুরি করার পরে স্থানীয় এক যুবককে বিয়ে করে গা-ঢাকা দিয়েছেন। যদিও ওই বস্ত্র ব্যবসায়ীর তরফে পুলিশে লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়নি।
চাঁদনি মোড় এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, থানায় অভিযোগ দায়ের না করে নিজামুদ্দিনের পরিবারের লোকজন আইন নিজেদের হাতে তুলে নেন। ওই তরুণীকে না পেয়ে পাশের পাড়ায় তাঁর বাবা, মা ও ছোট ভাইকে বাড়ি থেকে তুলে এনে নিজেদের বাড়িতে আটকে রাখেন তাঁরা। তরুণীর ভাই যাতে পালাতে না পারে, সে জন্য দড়ি দিয়ে তার হাত বেঁধে রাখা হয়। নির্যাতিত পরিবারটির অভিযোগ, এর পরে দু’দিন তাদের খেতে না দিয়ে চলে মারধর ও নির্যাতন। তার পরে ওই পরিবারের তিন সদস্যকে হাজির করানো হয় নিজামুদ্দিনের ‘বিএমডব্লিউ’ নামে বাড়ির মাঠের সামনে একটি দালানে। সেখানে শতাধিক মানুষের সামনে বসে সালিশি সভা।
সেই সভায় পরিচারিকা তরুণীর বিরুদ্ধে ২০ লক্ষ টাকা চুরির অপবাদ দিয়ে তাঁর বাবা ও ভাইকে নেড়া করে দেওয়ার পাশাপাশি মায়ের মাথার চুল কেটে দেওয়া হয় সকলের সামনে। ভুক্তভোগী পরিবারটির অভিযোগ, ঘটনার সময়ে প্রচুর লোকজন হাজির থাকলেও কেউ প্রতিবাদ করেননি। বরং, প্রায় তালিবানি শাসনের সমার্থক এ ভাবে হেনস্থায় ইন্ধন জুগিয়েছেন।
এই ভিডিয়ো ভাইরাল হওয়ার পরেই ঘটনাটি পুলিশের নজরে আসে। মঙ্গলবার রাতেই নিজামুদ্দিনের বাড়িতে যায় পুলিশ। কিন্তু তদন্তকারীদের দাবি, তার আগেই বাড়ির সব পুরুষ সদস্য গা-ঢাকা দেন।
ওই দিনের ঘটনার বিবরণ দিয়ে নির্যাতিত পরিবারটির গৃহকর্তা বলেন, ‘‘আমাদের উপরে ওরা দু’দিন ধরে মারধর, অত্যাচার চালিয়েছে। এর পরে ভিটেছাড়া করে ছেড়েছে। হুমকি দিয়েছে, এলাকায় দেখতে পেলেই খুন করবে। ভয়ে লিলুয়ার জগদীশপুরে ঘর ভাড়া নিয়ে চলে এসেছি।’’ আতঙ্কে জড়োসড়ো পরিবারটির কনিষ্ঠ সদস্য, বছর পনেরোর ওই কিশোর বলে, ‘‘ওরা আমার হাত দড়ি দিয়ে এমন ভাবে বেঁধে রেখেছিল যে, মনে হচ্ছিল, আমি চুরি করেছি। দু’দিন খেতে পর্যন্ত দেয়নি।’’
ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসতেই তৎপর হয় হাওড়া সিটি পুলিশ। প্রথমেই নির্যাতিত পরিবারটিকে জগদীশপুর থেকে খুঁজে বার করে জগদীশপুর তদন্ত কেন্দ্রের পুলিশ। তাঁদের থানায় ডেকে বুধবার দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এর পরে পরিবারটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করে। যার ভিত্তিতে ডোমজুড় থানার পুলিশ উত্তর কলোরা থেকে আব্দুল হাসান, সায়ন লস্কর ও ঈশা লস্কর নামে তিন যুবককে গ্রেফতার করে। আরও তিন জনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
পুলিশ জানায়, ধৃতদের মধ্যে আব্দুলকে মহিলার চুল কাটতে এবং তাঁর স্বামী ও ছেলেকে নেড়া করতে দেখা গিয়েছিল। আর আব্দুলকে সাহায্য করেছিল সায়ন। হাওড়া সিটি পুলিশের এক পদস্থ কর্তা বলেন, ‘‘ধৃতদের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থা, নির্যাতন, মারধর— সব ধারায় মামলা করা হয়েছে। এই ঘটনায় আরও যারা জড়িত, তাদের খোঁজ চলছে। সকলকেই গ্রেফতার করা হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy