গঙ্গা দিয়ে গড়িয়ে গিয়েছে সাত বছরের জল। তীরবর্তী হাওড়া আর বালি জড়িয়েই রইল বিচিত্র আইনি জটে। নির্বাচিত পুরসভা নেই। হাওড়া শহরের গলিঘুঁজি দেখলে মনে হয়, যত্রতত্র ‘ভাগাড়’। দুর্গন্ধ, দূষণ যেন কলকাতার যমজ শহরের সঙ্গে লেপ্টে রয়েছে। সেই হাওড়ারই বেলগাছিয়া ভাগাড়ের ধস, লাইন দিয়ে বাড়িতে ফাটল, পানীয় জল সরবরাহে বিপর্যয়, বিস্তীর্ণ এলাকা ভেসে থাকার ছবিতে যখন দৃশ্যতই নাগরিক জীবনের করুণ দশা, তখন পুরনো প্রশ্নগুলিই নতুন করে উঠছে— সাত বছর ধরে কেন ভোট হয় না হাওড়ায়? কেন কাউন্সিলরহীন হয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে মানুষকে? পাড়ার সমস্যার কথা লোকে কাকে বলবে?
২০১৮ সাল থেকে হাওড়া পুরনিগমের ভোট বকেয়া রয়েছে। হাওড়ার সঙ্গে বালি পুরসভাকে সংযুক্ত করেছিল রাজ্য সরকার। সেই সংক্রান্ত বিল পাশ হয়েছিল বিধানসভায়। কিন্তু বিলে সই করেননি তৎকালীন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়। তার পর আবার হাওড়া থেকে বালিকে পৃথক করারও বিল পাশ হয়েছে। তাতেও অনুমোদন আসেনি রাজভবন থেকে। জটিলতা আর আইনের ফাঁসেই ঝুলে রয়েছে হাওড়ার ভোট। বেলগাছিয়ার ভাগাড় বিপর্যয় ফের এক বার পুর-প্রশাসনের ‘শূন্যতাকে বেআব্রু’ করে দিল।
স্থানীয়দের বক্তব্য, সাধারণ বিষয়েও শংসাপত্রের জন্য এখন বিধায়ক বা সাংসদকে খুঁজতে হয়। পুর প্রশাসনের সঙ্গে জুড়ে থাকা তৃণমূলের লোকজনও একান্ত আলোচনায় মানছেন, কাউন্সিলর থাকা আর না-থাকার কী ফারাক, তা হাওড়ার মানুষ টের পাচ্ছেন। নিকাশি, পানীয় জলের সমস্যা দাঁড়িয়ে থেকে তদারকি করেন কাউন্সিলরেরা। কিন্তু ভোট না-হওয়ায় কারও নির্দিষ্ট দায়িত্ব নেই। বিস্তীর্ণ এলাকা দেখার ভার পড়ছে প্রশাসকমণ্ডলীর যে সদস্যের উপর, তিনিও সবটা সামলে উঠতে পারছেন না।

ভাগাড় বিপর্যয় নিয়ে রাজনৈতিক চাপানউতর তুঙ্গে। —নিজস্ব চিত্র।
ভাগাড় বিপর্যয়ের পর এক সপ্তাহ কাটতে চললেও লাগোয়া এলাকার বহুলাংশে এখনও জল দাঁড়িয়ে। নিকাশির কাজ করবে কে? কেউ জানেন না। ভোট হলে, কাউন্সিলররা নির্বাচিত হলে, বরোগুলি সক্রিয় হলে যে কাজ হয়, তা থমকে। দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন স্থানীয় মানুষ। কিন্তু তা শোনার কেউ নেই। অনেকের এ-ও অভিযোগ, নিকাশির কাজে সাফাইকর্মীর থেকে এখন ‘সুপারভাইজ়ার’-এর সংখ্যা বেশি হয়ে গিয়েছে।
সাত বছর ধরে হাওড়ার পুর প্রশাসন পরিচালনা করছে প্রশাসকমণ্ডলী। বর্তমানে প্রশাসক পদে রয়েছেন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ সুজয় চক্রবর্তী। প্রশাসকমণ্ডলী দিয়ে হাওড়ার ছবি বদলায়নি। শাসকদল অবশ্য দাবি করছে, ভাগাড় বিপর্যয়ের সঙ্গে ভোটের কোনও যোগ নেই। পুর প্রশাসক সুজয়ের বক্তব্য, ‘‘ভাগাড় বিপর্যয়ের সঙ্গে ভোটের সম্পর্ক নেই। ওখানে ১০০ বছর ধরে আবর্জনা জমছিল। পরিস্থিতি আন্দাজ করেই কাজ শুরু করেছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য, তার মধ্যেই ধসের ঘটনা ঘটে গিয়েছে।’’ কিন্তু ভোট না-হওয়া কি পুর পরিষেবায় কোনও প্রভাব ফেলছে না? সুজয়ের জবাব, ‘‘গণতন্ত্রে ভোট হওয়াই কাম্য। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও চেয়েছিলেন কলকাতার সঙ্গেই ভোট হয়ে যাক। কিন্তু তৎকালীন রাজ্যপাল (জগদীপ ধনখড়) বিল আটকে রেখে ভোট করতে দেননি।’’
গত বছর অক্টোবর মাসে মুখ্যমন্ত্রীই হাওড়ার যত্রতত্র আবর্জনার স্তূপ নিয়ে প্রশাসনিক বৈঠকে উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন। জঞ্জাল সাফাইয়ের দায়িত্ব দিয়েছিলেন উত্তর হাওড়ার বিধায়ক গৌতম চৌধুরীকে। গৌতম এক সময়ে পুর বোর্ডে মেয়র পারিষদ (আবর্জনা) ছিলেন। ফলে তাঁর সেই কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে। ভাগাড় বিপর্যয়ের পরে সেই গৌতমকে নিশানা করেছেন হাওড়ার বিজেপি নেতা উমেশ রাই। তাঁর কথায়, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী দায়িত্ব দিয়েছিলেন বিধায়ক গৌতমকে। কিন্তু তিনি ব্যর্থ হয়েছেন।’’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘সাত বছর ধরে ভোট হয় না। কাউন্সিলর নেই। সাধারণ মানুষ কাকে গিয়ে কী জানাবে? হাওড়া শহর কার্যত নরকে পরিণত হয়েছে।’’
আরও পড়ুন:
পাল্টা গৌতম বলেছেন,‘‘হাওড়ায় কোনও সমস্যা নেই। একটা ঘটনা ঘটেছে। প্রশাসন ব্যবস্থা নিচ্ছে।’’ কিন্তু কাউন্সিলর না-থাকলে দৈনন্দিন কাজে যে প্রভাব পড়ে সে ক্ষেত্রে? গৌতমের সোজা জবাব, ‘‘বাংলায় একটা পঞ্চায়েতের বিষয়েও খেয়াল রাখেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর নির্দেশেই পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম পদক্ষেপ করছেন। ফলে ভোট-ফোট কোনও ব্যাপার না। সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’’
বেলগাছিয়া এলাকার সিপিএম নেতা অশোক দত্ত বলেছেন, ‘‘ওরা ভোট করতে ভয় পাচ্ছে কেন? এক বার বালিকে যুক্ত করল। আবার বালিকে বাদ দিয়ে দিল। সরকারের অপদার্থতায় হাওড়া শহরের আজ এই দুর্দশা। ভাগাড়ের ঘটনা বড় আকারে হয়েছে বলে আজকে প্রশাসনের টনক নড়েছে। কিন্তু প্রতি দিন মানুষকে যন্ত্রণা ভোগ করতে হচ্ছে।’’
আপাতত ঠিক হয়েছে, বেলগাছিয়া ভাগাড়ের বদলে শিবপুরে আড়ুপাড়ায় কয়েক মাস আবর্জনা রাখা হবে। তার পর হুগলির বৈদ্যবাটি এবং বাইপাসের ধারের ধাপায় ফেলা হবে হাওড়ার ময়লা। এর ফলে না-হয় ভাগাড়ের সমস্যা মিটল। কিন্তু গোটা হাওড়ার পাড়ায় পাড়ায় নাগরিক সমস্যা সমাধানের বিষয়টি কী হবে? বিরোধীরা বলছে, তৃণমূলের দায়। তৃণমূল দেখাচ্ছে রাজভবন। আর হাওড়া ভোগ করছে নরকযন্ত্রণা।