প্রতীকী ছবি।
চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মাটির বাড়ির মধ্যে বেমানান ভাবে দাঁড়িয়ে দোতলা পাকা বাড়ি। নতুন রং হয়েছে। বাড়ির সামনে নামী সংস্থার আধুনিক মডেলের দুটি বাইক। সকালেও চোখ ঝলসানো হলুদ সিল্কের পাঞ্জাবি, গলায় মোটা সোনার চেন পরে বাড়ি থেকে যে বেরিয়ে এল, তার বয়স পঞ্চাশের আশপাশে। বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর স্টেশন থেকে গাড়িতে আধ ঘণ্টার পথ। খবর মিলেছিল, বিভিন্ন জেলা থেকে ‘তুলে আনা’ মেয়েদের ভিন রাজ্যে পাচারের আগে দিন কয়েক রাখা হয় এই বাড়িতে। দালালদের নিজস্ব ভাষায়— ‘মিড-ওয়ে সেন্টার’।
এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছিল, মাঝেমধ্যেই তাঁরা নতুন মেয়েদের মুখ দেখেন। কিন্তু সে বড়জোর দু’তিন দিনের জন্য। মুখগুলো বদলে যায় দ্রুত। আপনারা কখনও কিছু জানতে চাননি? এক প্রৌঢ়ের জবাব, ‘‘এখানে কার অত সাহস? কত বড় বড় লোকজন এই বাড়িতে আসে। ‘পুলিশ’ লেখা গাড়ি থেকেও লোক নামতে দেখেছি। এখানে মুখ খুলে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনব নাকি?’’
ভয়টা যে অমূলক নয়, বোঝা গেল অচিরেই। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মী পরিচয়ে গ্রামের মহিলাদের বৃত্তিমূলক শিক্ষা নিয়ে কথা বলার অছিলায় যাওয়া সাংবাদিককে শুরুতেই হলুদ পাঞ্জাবি বলল, ‘‘এনজিও-ফেনজিও নয়, মিডিয়ার লোক তো! খবর নেওয়া হয়ে গিয়েছে আমার। ঝুটমুট কষ্ট করলেন। কেউ কিছু করতে পারবে না। আমি তো একা নই। আমার মতো এজেন্টরা ছড়িয়ে আছে সব জায়গায়। কোন কোন জায়গায় যাবেন?’’ আশপাশের মাটির বাড়িগুলো থেকে একটা-দুটো করে মুখ বেরিয়ে আসছিল কৌতূহলের বশেই। সে দিকে তাকিয়ে হলুদ পাঞ্জাবির হুঙ্কার, ‘‘এখানে সার্কাস হচ্ছে নাকি?’’ মুহূর্তে সুনসান চারপাশ।
হলুদ পাঞ্জাবি জানিয়েছিল, তার ‘কাজের এরিয়া’ উত্তর আর দক্ষিণ ২৪ পরগনা। মেয়ে পাঠানো হয় মহারাষ্ট্র আর দিল্লিতে। তার দুই বন্ধু আছে। একজন তামিলনাড়ুতে আর অন্যজন অন্ধ্রপ্রদেশে ‘সাপ্লাই’ করে। ‘‘আমরা সরাসরি পাঠাই না। আগে কোথাও দিনকতক রাখি। তার পর বুঝিয়েসুঝিয়ে আসল জায়গায় পাঠানো হয়। তবে এখন ‘লোকাল ডিম্যান্ড’ও বেশি।’’ ‘লোকাল’? জবাব আসে, ‘‘ঝড়খালির কয়েকটা রিসর্টে। বোলপুর আর মুর্শিদাবাদেও।’’
বোলপুর? স্পষ্ট উত্তর, ‘‘হ্যাঁ, শান্তিনিকেতন!’’ রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন লীনা গঙ্গোপাধ্যায় জানালেন, বোলপুর থেকে এমন একাধিক অভিযোগ তাঁদের কাছেও এসেছে। তিনি বলেন, ‘‘প্রথমে অবাক হয়েছিলাম। পরে দেখা গেল, খবর ভিত্তিহীন নয়।’’
রাজ্য জুড়ে এমন ‘মিড-ওয়ে সেন্টারের’ সংখ্যা প্রচুর। কোথাও ভিন শহরে নাচের স্কুল চালানোর কথা বলে, কোথাও প্লেসমেন্ট এজেন্সি, কোথাও বা ফিজিওথেরাপি বা মাসাজের প্রশিক্ষণ দেওয়ার নাম করে এই সব সেন্টারে মেয়েদের আনা হয়। গাড়িতে, ট্রেনে বা বিমানে মূল গন্তব্যে পৌঁছনোর পথে এই মেয়েরা যাতে কোনও ভাবে বিপত্তির কারণ না হন, তাই তাঁদের মৌখিক, শারীরিকভাবে ভয় দেখিয়ে মুখ বন্ধ রাখা হয়। পাচার নিয়ে দীর্ঘ দিন কাজ করা এক সরকারি আধিকারিক জানান, বেশির ভাগ সময়ে ধর্ষণ, এমনকি খুনের ভিডিয়ো দেখানো হয় এই মেয়েদের। মুখ খুললে তাঁদের পরিণতি কী হতে পারে, তা দেখিয়ে মনোবল পুরোপুরি ভেঙে দেওয়া হয়।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মীরা তো বটেই, এমনকি সমাজকল্যাণ দফতর, নারী ও শিশু কল্যাণ দফতরের কর্তাদের একাংশও মেনে নিয়েছেন এই সব সেন্টারের খবর পুলিশ-প্রশাসনের অজানা নয়। রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় গত কয়েক বছরে রমরম করে বেড়েছে এই ব্যবসা। সমাজকল্যাণ দফতরের এক কর্তার কথায়, ‘‘এদের একটাই কথা, সব জায়গায় ‘সেটিং’ করা আছে। দাবিটা মিথ্যেও নয়। মেয়ে পাচারের ব্যবসায় ‘ইনভেস্টমেন্ট’ সামান্য। কিন্তু মুনাফা প্রচুর। তাই সর্বত্র টাকা ছড়িয়ে রাখতে পারে এরা। সেই চক্রটাই আমরা ভাঙার চেষ্টা করছি।’’
হুগলির একটি বাড়ির কথা যেমন আলাদাভাবে উল্লেখ করেছেন একটি সংগঠনের প্রতিনিধিরা। সেখানে হানা দিয়ে বার দু’য়েক কয়েকটি মেয়েকে উদ্ধার করা হয়েছে। ফের যে কে সেই। হুগলির চাঁপাডাঙার কিছুটা দূরে সেই এলাকার একটি ঘটনার কথা জানালেন স্থানীয় বৃদ্ধ। এক রাতে একটি অচেনা মেয়ে (যাকে এক ঝলক দেখে ১৬-১৭র বেশি বয়স বলে মনে হয়নি। এলাকার লোকেরা আগে তাকে দেখেনওনি) বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছুটতে শুরু করেছিল। পাড়ার ক্লাবঘরে তখনও রাতে দু’চার জন ছিলেন। খোলা ছিল স্থানীয় একটি দোকানও। সকলের সামনে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে তাকে ধরে ফেলে ভিতরে নিয়ে যায় দু’-তিন জন মহিলা ও পুরুষ। পর দিন সকালে মেয়েটির মৃতদেহ বেরিয়েছিল বাড়ি থেকে। বাড়ির মালিক পাড়ায় জানিয়েছিল, তার বাড়িতে বেড়াতে আসা ভাইঝির রাতে হার্ট অ্যাটাক হয়েছে।
নারী পাচার ঠেকানোর জন্য এত পরিকল্পনা। সেই পরিকল্পনা খাতে লক্ষ লক্ষ টাকা। সবই কি তা হলে ভস্মে ঘি ঢালা? সমাজকল্যাণ মন্ত্রী শশী পাঁজার দাবি, পরিস্থিতি আগের চেয়ে অনেকটা ভাল হয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘পাচার নিয়ে ক্রমাগত প্রচারে মানুষ অনেক বেশি সতর্ক। তাঁরাই সন্দেহজনক কিছু দেখলে প্রশাসনকে খবর দিচ্ছেন। উদ্ধার হওয়া মেয়েরাও অনেককে ধরিয়ে দিতে পেরেছেন। অর্থাৎ ছবিটা বদলাচ্ছে।’’
বদলাচ্ছে? ভিন রাজ্যের যৌনপল্লির ছবি কিন্তু সে কথা বলছে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy