ফাইল চিত্র।
পকেটে রেস্ত, আর মাথায় দাদাদের হাত। সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় নিয়োগ-পোস্টিং-এর নেপথ্যে এটাই নাকি ধ্রুব সত্য। আর তাই যুগে যুগে 'কোন জেলা-কোন হাসপাতাল-কত রেট'-এর অলিখিত চার্ট তৈরিই থাকে। শুধু টাকার অঙ্ক বাড়ে লাফিয়ে লাফিয়ে। স্বাস্থ্য কর্তাদের একাংশ আড়ালে স্বীকার করেন, হিসেব মিলে গেলে ভাল। নয়তো অবন্তিকা ভট্টাচার্যের মতো কিছু নাম আচমকাই ভেসে উঠতে পারে।
মেদিনীপুরে বদলির পর আট বছর কাটিয়ে কলকাতার বাসিন্দা, শিক্ষক-চিকিৎসক অবন্তিকা বাড়ির কাছাকাছি ফেরার আবেদন করেছিলেন। তাঁর অটিস্টিক মেয়ের জন্য। কিন্তু পাননি। গায়ে আগুন দিয়ে মৃত্যুর আগে সরকারের বদলি নীতি নিয়ে ফেসবুকে একাধিক প্রশ্ন তুলেছিলেন তিনি।
এখন প্রশ্ন উঠছে, এই ঘটনার আট মাস পরে সরকারের সাম্প্রতিক বদলি নীতি কি তা হলে এক অর্থে প্রায়শ্চিত্তের চেষ্টা? রাজ্যে তৃতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পরে স্বাস্থ্যে কতটা প্রভাব ফেলতে পেরেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার? এ ক্ষেত্রে অবন্তিকার মৃত্যু ও সরকারি শিক্ষক-চিকিৎসকদের বদলি নীতিকে এক সুতোয় গেঁথে দুইয়ের মধ্যে যোগসূত্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন অনেকে। দুর্নীতির ঘুঘুর বাসা ভাঙার পাশাপাশি একে রেফার রোগের ভূত ছাড়ানোর জন্য সদর্থক দাওয়াই বলেও মনে করছেন স্বাস্থ্য কর্তাদের একাংশ। পোস্টিং 'মনের মতো' হলে ফাঁকি মারার প্রবণতা কমবে এটা মনে করেই নাকি এমন চেষ্টা।
প্রশ্ন হল, সেই চেষ্টার মধ্যে কতটা চমক আর কতটাই বা তাকে সফল করার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা? দুধ আর জল আলাদা করা যে বড্ড কঠিন!
নয়া বদলি নীতিতে স্বাস্থ্য পরিষেবাকে চারটি জ়োনে ভাগ করা হয়েছে। আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, চাকরি জীবনের শুরুতে পছন্দের জ়োনে কাজে যোগ দেওয়া যাবে। সন্তানের একক অভিভাবকত্ব, সন্তানের শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধকতা, চিকিৎসকের নিজের প্রতিবন্ধকতার বিষয়গুলিও পোস্টিং-এর সময়ে মানবিক ভাবে বিবেচনা করবে দফতর। কিন্তু এই আশ্বাসে ভরসা রাখতে পারছেন না অনেকেই।
অ্যাসোসিয়েশন অব হেলথ সার্ভিস ডক্টরস -এর সাধারণ সম্পাদক মানস গুমটা বলেন, ‘‘বদলির ভয় দেখিয়ে রাজনৈতিক আনুগত্য আর টাকা আদায়ের ট্র্যাডিশন বন্ধ হয়নি। নতুন নীতিতেও এমন কিছু ফাঁক আছে, যাতে তা হবে বলেও মনে হয় না। আর কে না জানে, সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বহু ডাক্তার প্রত্যন্ত জায়গায় একবার গেলে আর ফিরতে পারেন না। আর কিছু লোকের ক্ষেত্রে কোনও নিয়মই খাটে না। তাঁরা বছরের পর বছর পছন্দের জায়গায় থেকে যান।’’
ঠিক যে ভাবে যুগে যুগে রেফার-রোগও একই রকম সংক্রামক হয়ে রাজত্ব করে চলে। দফতরের শীর্ষকর্তারা মানছেন, রোগ এখন আরও জাঁকিয়ে বসেছে। গত ১০ বছরে রাজ্যে একাধিক মেডিক্যাল কলেজ, বেশ কিছু মাল্টিস্পেশালিটি, সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল চালুর পরেও এই অবস্থা কেন? এই প্রশ্ন করলে স্বাস্থ্যকর্তারা মুখ চাওয়াচাওয়ি করেন। কারণ, তাঁরা জানেন, কোনও স্তরেই কোনও নজরদারি নেই। সম্প্রতি বলা হয়েছে, অকারণ রেফার করা হলে এবং সেই কারণে রোগীর কোনও ক্ষতি হলে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক তো বটেই, হাসপাতালের সুপারের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অর্থাৎ আবারও জ্বরের কারণ না খুঁজে শুধু প্যারাসিটামল দিয়ে জ্বর কমানোর চেষ্টা!
ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের এক চিকিৎসকের কথায়, ‘‘আমাদের শাঁখের করাত অবস্থা। দু'দিকেই কাটবে। ২৪ ঘণ্টা এক্সরে, ইসিজি-ও হয় না। গুরুতর রোগী এলে চিকিৎসা শুরু হবে কী ভাবে? রেফার করলে শাস্তি। আর রেফার না করে রেখে দিলে যদি রোগীর কিছু হয়ে যায়, তখন কেন অন্যত্র রেফার করলাম না সেই প্রশ্ন তুলে আমাদের পেটানো হবে।’’
কাগজে-কলমে যা-ই থাকুক না কেন, জেলা স্তরে বহু জায়গায় পরিকাঠামো এখনও দুর্বল। পরিকাঠামো মানে যে শুধু ঝাঁ চকচকে বাড়ি আর দামি যন্ত্র নয়, তা মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী এখনও মেনে উঠতে পারেননি। জেলায় চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্য কর্মীদের নিয়োগ আরও বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। তাঁদের বেতন, প্রোমোশন নীতি যথাযথ করতে হবে।
বসবাসের উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে হবে। আর তার পরেও রেফার বাড়তে থাকলে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। মৌখিক হুঁশিয়ারি নয়, বাস্তবিক শাস্তি। স্বাস্থ্যকর্তাদের একাংশ মনে করেন, সব রকম পরিকাঠামো থাকা কলকাতার কোনও মেডিক্যাল কলেজ থেকে কোনও চিকিৎসক যদি অকারণে রোগী ফেরান, আর রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে সেই রোগী মারা যান, তা হলে সুপার নয়, শাস্তি সেই ডাক্তারকেই দিতে হবে। ডাক্তার ইউনিয়নের ভয়ে মৌখিক হুঁশিয়ারি দিয়ে ছেড়ে দিলে চলবে না। রেফার করতে হলে রোগীকে স্থিতিশীল করে, সরকারি অ্যাম্বুল্যান্সেই অন্যত্র পাঠাতে হবে। মনে রাখতে হবে, বেসরকারি অ্যাম্বুল্যান্স বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রোগীকে নার্সিংহোমের দরজায় পৌঁছে দিয়ে কমিশন নেয়, সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যায় না। এ জন্য অ্যাম্বুল্যান্স কেনা এবং চালক নিয়োগের জন্য আলাদা বরাদ্দের ব্যবস্থা করতেই হবে সরকারকে।
জেলায় প্রতি মাসে হাজিরা খাতায় ডাক্তারের সই থাকে। বাস্তবে সপ্তাহে একদিন বা দু'দিন তাঁরা আসেন। চিকিৎসা, পঠনপাঠন, ধাক্কা খায় সবটাই। কিন্তু এই আক্ষেপ তো বহু বছরের। ব্যবস্থা হচ্ছে ক'জনের বিরুদ্ধে? দফতরের এক শীর্ষ কর্তার কথায়, "জনমোহিনী নীতি না নিয়ে স্বাস্থ্যে দরকার মতো অপ্রিয় হওয়া জরুরি। এটাই আমরা ওঁকে বুঝিয়ে উঠতে পারি না।"
ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরাম-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য অর্জুন দাশগুপ্ত মনে করেন, এর আগের দফায় কোভিড মোকাবিলায় সরকারের যে তৎপরতা ছিল, এ বার তা নজরে আসেনি। ডাক্তারদের প্রতি একের পর এক আক্রমণের ক্ষেত্রেও কোনও সদর্থক ভূমিকা দেখা যায়নি। তিনি বলেন, ‘‘দফতরের বিভিন্ন দুর্নীতি, কোভিডের ওষুধ বাইরে বিক্রি ইত্যাদি অভিযোগের ক্ষেত্রে তদন্তের পর দোষীদের চিহ্নিত করা হয়েছিল। কিন্তু তার পরেও তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এতে মানুষের কাছে ভুল বার্তা যাচ্ছে।’’ স্বাস্থ্যসাথী কার্ড শুধুমাত্র আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্য সীমাবদ্ধ না রেখে 'সর্বজনীন' করার সিদ্ধান্তও যুক্তিসঙ্গত নয় বলে মনে করে
ডক্টরস ফোরাম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy