জাল ওষুধের চক্র নির্মূল করতে কেন্দ্র বা রাজ্যের ড্রাগ কন্ট্রোলের পরিকাঠামোর অনেক ঘাটতি যেমন আছে, তেমনই প্রশ্ন উঠেছে, জাল ওষুধের কারবারিদের ফাঁদে কী ভাবে পা দিচ্ছেন পাইকারি থেকে খুচরো ব্যবসায়ীদের একাংশ? সবটাই কি তাঁরা জেনে করছেন? না কি প্রতারিত হচ্ছেন? সম্প্রতি জাল বা ভেজাল ওষুধের রমরমার তদন্তে নেমে যে তথ্য পেয়েছে কেন্দ্র ও রাজ্যের ড্রাগ কন্ট্রোল, তাতে স্পষ্ট, অতিরিক্ত মুনাফার লোভে জাল ওষুধের কারবারিদের ফাঁদে পড়ছেন পাইকারি এমনকি, খুচরো ব্যবসায়ীদের একাংশ।
আমতার পাইকারি ব্যবসায়ী বাবলু মান্নাকে (তাঁর জামিনের আবেদন নাকচ নিম্ন আদালতে) গ্রেফতার করা হয় সম্প্রতি। সূত্রের খবর, আমতা কাণ্ডে হরিয়ানার এক ভুয়ো ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থার মালিককেও গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু ওই মালিকের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ছিল না বাবলুর। বরং বিহার থেকে এক জন নিজেকে ওই নামী সংস্থার প্রতিনিধি পরিচয়ে ফোন করে বাবলুর সঙ্গে ব্যবসা শুরু করে। ড্রাগ কন্ট্রোলের আধিকারিকরা জানাচ্ছেন, জাল ওষুধ চক্রে দেশ জুড়ে এমন অসংখ্য ‘লিঙ্কম্যান’ ছড়িয়ে রয়েছে। যারা ‘ভার্চুয়াল মাধ্যম’-এ পুরো ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে। ওষুধ ব্যবসায়ীদের একাংশের কাছে ফোন আসে ওই ‘লিঙ্কম্যান’দেরই। সেখানেই স্থির হয়, কত শতাংশ ছাড়ে মিলবে ওষুধ। যত বেশি টাকার ওষুধ কেনা হবে, ছাড়ের পরিমাণও তত বেশি হয়।
কিন্তু কী ভাবে ব্যবসায়ীদের খুঁজে বার করে ওই জালিয়াতেরা? ড্রাগ কন্ট্রোল সূত্রের খবর, কলকাতার বড়বাজার এলাকার পাইকারি ওষুধের বাজারে ভুয়ো পরিচয়ে ঘুরে বেড়ায় কিছু জালিয়াত। যারা লক্ষ রাখে, কোন ব্যবসায়ীর লেনদেন কত বেশি। এর পরে, সুযোগ বুঝে নামী ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থার প্রতিনিধি বলে নিজেদের পরিচয় দিয়ে ওই ব্যবসায়ীদের একাংশের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে। সেখান থেকেই ফোন নম্বর পৌঁছে যায় ভিন্ রাজ্যে থাকা ‘লিঙ্কম্যান’দের কাছে। তারাও নামী ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থার প্রতিনিধি বলে পরিচয় দিয়ে ওই ব্যবসায়ীদের ফোন করে ১৮-২০ শতাংশ ছাড়ে ওষুধ দেওয়ার প্রলোভন দেখায়। এ রাজ্যের ওষুধ ব্যবসায়ীদের সংগঠন ‘বেঙ্গল কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট অ্যাসোসিয়েশন’ (বিসিডিএ)-র সাধারণ সম্পাদক পৃথ্বী বসুর কথায়, “সরকারি স্ট্যান্ডার্ড প্রোটোকল অনুযায়ী ১০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দিতে পারে প্রস্তুতকারী সংস্থা। তার থেকে বেশি ছাড় শুনেই সন্দেহ হওয়া উচিত। কিন্তু তার পরেও বেশি মুনাফার লোভে ওই সব পাইকারি ব্যবসায়ী জাল ওষুধ কিনে দোকান ভরাচ্ছেন। এই জন্যই নির্দিষ্ট সংস্থা ছাড়া অচেনা-অজানা হাতছানিতে সাড়া দিতে সদস্যদের বারণ করা হয়। কিন্তু ওই ব্যবসায়ীরা কর্ণপাত করেন না।” সম্প্রতি প্রতিটি জেলায় সদস্যদের নিয়ে সতর্কতা শিবির শুরু করছে বিসিডিএ।
সূত্রের খবর, তদন্তে দেখা গিয়েছে জাল ওষুধ সরবরাহকারী সংস্থার মালিক তো বটেই, ‘লিঙ্কম্যান’কেও সামনে থেকে দেখার সুযোগ মেলে না ব্যবসায়ীদের। কারণ, কখন কী ভাবে ওষুধ সরবরাহ হবে, তা জানানো থেকে বিল পাঠানো, টাকা লেনদেন সবটাই হয় ফোন এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। আর, জালিয়াতের ফাঁদে পা দেওয়া ব্যবসায়ীর থেকেই তাঁর ঘনিষ্ঠ আর এক ব্যবসায়ী ওই সমস্ত প্রতিনিধি বা সংস্থার খোঁজ পান। কিন্তু ভিন্ রাজ্য থেকে আসা ফোনকে কেন বিশ্বাস করছেন ওই ব্যবসায়ীরা?
আসল রহস্য এখানেই লুকিয়ে রয়েছে বলে মত তদন্তকারীদের একাংশের। সূত্রের খবর, প্রতিটি ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থার প্রতিনিধিদের ব্যবসার মাসিক লক্ষ্যমাত্রা (টার্গেট) থাকে। সেটি পূরণ করলে মেলে নির্দিষ্ট ‘ইনসেনটিভ’। বহু ক্ষেত্রেই মাসের শেষে লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য ওই প্রতিনিধিরা কিছু পাইকারি ব্যবসায়ীকে কাজে লাগান। প্রতিনিধিরা নিজেদের পকেট থেকে কিছু টাকা দেন ওই ব্যবসায়ীকে, যাতে তিনি লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হওয়ার মতো ওষুধ কিনে নেন। তাতে প্রস্তুতকারী সংস্থা থেকে প্রায় ১০ শতাংশ ছাড় যেমন মিলছে, তেমনই অতিরিক্ত টাকাও পান সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী। এর পরে, ওই ওষুধ যাতে ঘরে না রেখে তিনি অন্য জেলা বা ভিন্ রাজ্যের পরিচিত ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করেন, তার জন্য আরও কিছু টাকা দেন প্রস্তুতকারী সংস্থার প্রতিনিধিই। কারণ, ওই ওষুধ স্থানীয় বাজারে থেকে গেলে পরের মাসে লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সমস্যা হতে পারে। এই ‘সমঝোতা’র (অ্যাডজাস্টমেন্ট) চল ‘ওপেন সিক্রেট’ বলে জানাচ্ছে ড্রাগ কন্ট্রোল, বিভিন্ন ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থাও। কিন্তু ওই ওষুধ তো জাল নয়, তা হলে?
ড্রাগ কন্ট্রোল সূত্রের খবর, বহু ক্ষেত্রেই ভিন্ রাজ্য থেকে নামী সংস্থার প্রতিনিধি বলে পরিচয় দেওয়া জালিয়াতেরা এই ‘অ্যাডজাস্টমেন্ট’-এর গল্প সামনে রাখছে। স্টক খালি করা বা লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য বেশি ছাড়ে ওষুধ ছেড়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখাচ্ছে। এক শ্রেণির ব্যবসায়ী বেশি মুনাফার লোভে ফাঁদে পা দিতেই, ভিন্ রাজ্যের সংস্থা থেকে অতি সহজে এ রাজ্যেও চলে আসছে জাল ওষুধ। ড্রাগ কন্ট্রোলের আধিকারিকদের কথায়, “জাল ওষুধের চক্রের ওই ‘লিঙ্কম্যান’দের ধরতে পারলেই অনেক রহস্য উন্মোচন করা যাবে।”
(শেষ)
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)