গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
বাংলার যে আসনগুলোয় ভোটের লড়াই সবচেয়ে তিক্ত হয়ে উঠেছিল এ বার, সেগুলোর অন্যতম তাঁর নির্বাচনী ক্ষেত্র। আসানসোলের মেয়র তথা পাণ্ডবেশ্বরের বিধায়ক জিতেন্দ্র তিওয়ারির সঙ্গে তাঁর প্রায় যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এ বার তাঁর জয়ের ব্যবধান আগের বারের প্রায় পৌনে তিন গুণে পৌঁছেছে। দ্বিতীয় বারের জন্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও হয়েছেন। আর শপথ নেওয়ার পরে আসানসোলে ফিরে সেই বাবুল সুপ্রিয় আবার চমকে দিয়েছেন। রাজ্যের প্রায় সর্বত্র যখন বিজেপিতে যোগ দেওয়ার ঢল, তখন আসানসোলে বাঁধ দিয়েছেন তিনি। আগে মনটাকে গেরুয়া রঙে রাঙান, তার পরে আসবেন— আসানসোলে সোজাসাপটা বার্তা বিজেপি সাংসদের।
‘স্ট্রংম্যান’ জিতেন্দ্র তিওয়ারির উপরে এ বার দায়িত্ব পড়েছিল আসানসোল উদ্ধার করার। বাবুলকে হারাতে সর্বশক্তি দিয়ে ময়দানে ঝাঁপিয়েছিলেন জিতেন্দ্র। ফলে ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছিল আসানসোল। গুলি-বোমার দাপট বা একের পর হামলা-পাল্টা হামলার খবর তো আসছিলই। বাবুল সুপ্রিয়র সঙ্গে জিতেন্দ্রর বাগ্যুদ্ধও চরমে পৌঁছেছিল।
ভোটের দিন যে ভাবে প্রায় গোটা আসানসোলে দাপট দেখিয়েছিল তৃণমূল, তাতে রাজনৈতিক শিবিরে ধারণা তৈরি হয়েছিল যে, বাবুল সুপ্রিয় জিতলেও ব্যবধান বেশি হবে না। কিন্তু বাবুলকে প্রায় দু’লক্ষে জিতিয়ে চমকে দিয়েছে আসানসোল। আর জনমতকে সম্মান জানাতে এ বার চমকে দিচ্ছেন বাবুলও। যাঁদের বিরুদ্ধে ধুন্ধুমার লড়াই চলল এত দিন ধরে, বিজেপির উত্থান দেখেই তাঁরা বিজেপিতে শামিল হতে চাইবেন আর বিজেপি-ও তৎক্ষণাৎ তাঁদের বরণ করে নেবে, এমনটা হতে দিতে বাবুল রাজি নন। তাই নিজের এলাকায় অন্তত দু’টি বিধানসভা কেন্দ্রে বড় সংখ্যায় বিজেপিতে যোগদানের চেষ্টা তিনি আটকে দিয়েছেন।
আরও পড়ুন: থমথমে ভাটপাড়ায় টহল দিচ্ছে পুলিশ-র্যাফ, মৃতদের দেহ নিয়ে বিকেলে শোকমিছিল
মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়ে দিল্লি থেকে আসানসোলে ফেরার পরে বিভিন্ন এলাকায় জনসভা করছিলেন বাবুল। মূলত বিজয় সমাবেশ। বারাবনি এবং জামুড়িয়ায় এই রকমই দু’টি সভায় তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়ার চেষ্টা বাবুল আটকে দিয়েছেন। স্থানীয় বিজেপি নেতাদের একাংশের সঙ্গে যোগাযোগ করেই ওই তৃণমূল কর্মীরা দলবদলের চেষ্টা করেছিলেন। বাবুলের সভাস্থলে তাঁরা হাজিরও হয়েছিলেন। কিন্তু বিজেপি সাংসদের সাফ বার্তা— এখনই আপনাদের দলে নেব না।
কেন এখনই দলে নেবেন না তৃণমূল কর্মীদের, সে ব্যাখ্যাও বাবুল সুপ্রিয় মঞ্চ থেকেই দিয়ে দেন। ১০ জুন জামুড়িয়ার সভা থেকে বাবুল সুপ্রিয় বলেন, ‘‘যে কেউ এসে বিজেপির ঝান্ডা ধরে নেবে, তা হতে দেব না। সব কিছু এত সহজ নয়। আমার যে ভাইয়েরা এত দিন লড়াই করেছেন, অত্যাচারিত হয়েছেন, তাঁদের মর্যাদার স্বার্থেই এখন তাঁদের সঙ্গে আপনাদের মেলাব না।’’
বাবুল সুপ্রিয়র এই অবস্থান বিজেপি কর্মীদের অনেককেই খুব সন্তুষ্ট করেছে। কিন্তু প্রশ্নও উঠেছে। আসানসোলে কি তা হলে দলকে আর নতুন করে বাড়তে দেবেন না সাংসদ? নতুন করে যাঁরা দলে আসতে ইচ্ছুক, তাঁদের কি ঠাঁই দেবেন না? সে প্রশ্নের জবাবও কিন্তু বাবুল জামুড়িয়ার সভা থেকেই দিয়ে দিয়েছেন। যাঁরা সে দিন তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিতে গিয়েছিলেন, তাঁদের উদ্দেশে বাবুল বলেন, ‘‘বিজেপিতে আসার আগে মনটাকে গেরুয়া রঙে রাঙাতে হবে, মোদীজিকে নেতা হিসেবে মানতে হবে। তার পরে দু’মাস বাদে অন্য অনুষ্ঠান করে দেখা যাবে, আপনাদের যোগদান করানো যায় কি না।’’
নিজের নির্বাচনী ক্ষেত্রে বাবুলের এই বার্তা সম্পর্কে বিজেপির রাজ্য নেতৃত্ব কী ভাবছে? ‘‘বাবুল সুপ্রিয় ঠিকই করেছেন। দলে সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছে যে, ইচ্ছা করলেই যে কেউ যাকে খুশি দলে যোগদান করাতে পারবেন না। যোগদান করতে ইচ্ছুক ব্যক্তি যে-ই হন, দলে আলোচনা না করে বা কর্মীদের মতামত না নিয়ে যোগদান করানো যাবে না।’’ বলছেন রাজ্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু। যে স্তরের নেতা বা কর্মী অন্য দল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিতে চাইবেন, সেই স্তরের দলীয় কমিটির মতামত নিয়ে তবেই যোগদান— এই নীতিই অনুসরণ করতে হবে, জানাচ্ছেন সায়ন্তন। তাঁর কথায়, ‘‘আসানসোলে যাঁরা যোগ দিতে চেয়েছিলেন, তাঁরা সম্ভবত বুথ স্তরের কর্মী। তাই বিজেপির সংশ্লিষ্ট বুথ কমিটির মতামত নিয়েই যোগদান করাতে হত। আচমকা কেউ লোকজন নিয়ে চলে এলেন আর সবাইকে দলে ঢুকিয়ে নেওয়া হল, এমনটা হতে পারে না।’’ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর পদক্ষেপকে সমর্থন করে সায়ন্তনের মন্তব্য, ‘‘বাবুল সুপ্রিয় গত পাঁচ বছর আসানসোলে কাজ করেছেন। তিনি এলাকাটা চেনেন। সুতরাং তিনি ভুল সিদ্ধান্ত নেবেন না।’’
আরও পড়ুন: খবর সংগ্রহে ‘সিভিক গোয়েন্দা’
তবে বিজেপি সূত্রের খবর, তৃণমূল বা অন্যান্য দল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিতে ইচ্ছুক যাঁরা, তাঁদের কিছুতেই বিজেপিতে ঢুকতে দেওয়া হবে না, এমন কোনও একগুঁয়ে অবস্থানও বাবুল সুপ্রিয় নেননি। মাসখানেক বা মাস দুয়েকের মধ্যে যোগদান করানোর জন্য বিশেষ সভার আয়োজন করা হবে। তার আগে বুথ কমিটি বা মণ্ডল কমিটিগুলোর মতামতও নিয়ে নেওয়া হবে। বিজেপির পশ্চিমাঞ্চল জোনের পর্যবেক্ষক নির্মল কর্মকারের কথায়, ‘‘যাঁরা দলে আসতে ইচ্ছুক, তাঁদের আমরা অবশ্যই নেব। বাবুল সুপ্রিয় এক বারও বলেননি, কাউকে নেওয়া হবে না। নেওয়া হবে। বুথ স্তরের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে মাসখানেক পরে আমরা যোগদান মেলার আয়োজন করব। সেখানেই ওঁদের স্বাগত জানানো হবে।’’
বাবুল সুপ্রিয় যে ভূমিকা নিয়েছেন আসানসোলে, সঙ্ঘও তেমনটাই চাইছিল বলে বিজেপি সূত্রের খবর। দলের জাতীয় কর্মসমিতির সদস্য মুকুল রায়ের হাত ধরে যে ভাবে হু হু করে দলবদল শুরু হয়েছিল, তাতে সঙ্ঘ মোটেই সন্তুষ্ট ছিল না। প্রথম সঙ্ঘ হস্তক্ষেপ করেনি। কিন্তু লাভপুরের মহাবিতর্কিত তৃণমূল বিধায়ক মনিরুল ইসলাম বিজেপিতে ঢোকার পরে গোটা দলে হইচই পড়ে যায়। সঙ্ঘ প্রথমে কৈলাস বিজয়বর্গীয়কে সতর্ক করে। তার পরে চলতি মাসের শুরু দিকে মুকুল রায়কেই নাগপুরে তলব করে। যাঁদের তীব্র বিরোধিতা করে বাংলার মানুষ বিজেপির দিকে ঝুঁকেছেন, তাঁদেরই বিজেপিতে সামিল করা হবে, এমনটা চলতে পারে না— সঙ্ঘের শীর্ষ স্তর থেকে মুকুলকে এই বার্তা দিয়ে দেওয়া হয় বলে রাজ্য বিজেপির একটি অংশই জানাচ্ছে।
আরও পড়ুন: স্বস্তির নিশ্বাস, অবশেষে বর্ষা ঢুকে পড়ল কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গে
সুতরাং বাবুল সুপ্রিয়র অবস্থান নিয়ে আপাতত প্রশ্ন তোলার অবস্থায় নেই কেউই। দলীয় নেতৃত্ব তো বটেই, আরএসএস-ও বাবুলের এই পদক্ষেপে সন্তুষ্ট বলে বিজেপি সূত্রে জানা যাচ্ছে। আর এত দিন ধরে লড়ে আসা কর্মীদের ‘মর্যাদা’র কথা যে ভাবে মঞ্চ থেকে জোর গলায় বলেছেন বাবুল, তাতে বিজেপির নীচের স্তরেও স্বস্তির হাওয়া বইছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy