হাই মাদ্রাসা পরীক্ষায় প্রথম সারিফা খাতুন তার মায়ের সঙ্গে। মালদহের রতুয়ায়। নিজস্ব চিত্র।
এক জনের বাবা ঝালমুড়ি বিক্রি করেন। অন্য জনের বাবার হাতে থাকে ট্রাকের স্টিয়ারিং। সে নিজে মায়ের সঙ্গে আবার বিড়ি বাঁধায় নিয়মিত হাত লাগায়। এ বারে যদি অনলাইনে পরীক্ষা হত, তা হলে এই দু’জন, সারিফা খাতুন ও আজিজা খাতুন, পরীক্ষাই দিতে পারত কি না সন্দেহ। কারণ, কারও নিয়মিত অনলাইন ক্লাস করার মতো নেট-সংযোগ-সহ স্মার্টফোনের সংস্থান নেই। কিন্তু হাই মাদ্রাসা পরীক্ষা অফলাইনে হয়েছে। প্রথম জন, সারিফা, ৮০০-এর মধ্যে ৭৮৬ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছে। কালিয়াচকের আজিজা ৭৭৩ পেয়ে তৃতীয় হয়েছে। দ্বিতীয় হয়েছে ইমরানা আফরোজ। সে পেয়েছে ৭৭৫।
এ বারের মাদ্রাসা বোর্ডের পরীক্ষায় জয়জয়কার ছাত্রীদের। তাদের মধ্যে আবার মেধাতালিকার প্রথম দিকে বেশির ভাগই মালদহের বাসিন্দা। সোমবার ফল প্রকাশের পরে দেখা যাচ্ছে, প্রথম, দ্বিতীয়, যুগ্ম তৃতীয়, চতুর্থ, যুগ্ম পঞ্চম, যুগ্ম নবম ও যুগ্ম দশম মালদহেরই ছাত্রী বা ছাত্র। সারিফা ও ইমরানা, দু’জনই মালদহের রতুয়ার ভাদো বটতলা হাই মাদ্রাসার ছাত্রী। মহম্মদ ওয়াকিল আনসারি তৃতীয়। সে গাজলের বাসিন্দা, বৈরগাছি রামনগর হাই মাদ্রাসার ছাত্র। একই নম্বর পেয়ে তার সঙ্গে যুগ্ম তৃতীয় হয়েছে কালিয়াচকের যদুপুরের আজিজাও। চতুর্থ রৌনাক জাহান গাজলের বাসিন্দা, রামনগর হাই মাদ্রাসার ছাত্রী। পঞ্চম কালিয়াচকেরই গয়েশবাড়ি নয়াবস্তির সানিয়া পরভিন। সে নয়মৌজা সুবহানিয়ে হাই মাদ্রাসার ছাত্রী। তার সঙ্গে যুগ্ম পঞ্চম হয়েছে মুর্শিদাবাদের লালগোলা রহমতউল্লাহ হাই মাদ্রাসার ছাত্রী সিয়াতুন নিসা।
সারিফাদের নুন আনতে পান্তা ফুরনো অবস্থা। বাড়ির সামনে রাখা আছে ঝালমুড়ির চলমান দোকান। কিন্তু ওই সামান্য রোজগারে সংসার চলে না, বলছিলেন সারিফার বাবা উজির হোসেন। ভাদো বটতলা হাই মাদ্রাসা থেকে পরীক্ষায় বসা ছাত্রী সারিফা আদতে পড়ত একটি স্থানীয় মিশনে। সেখানে এখনও তার চার মাসের টিউশন ফি বকেয়া আছে। তার বাবা স্বীকার করলেন, অভাবের সংসারে মাঝেমধ্যেই মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেওয়ার কথা ভাবতেন তাঁরা। কিন্তু মিশনের শিক্ষকেরা বুঝিয়ে নিরস্ত করেছিলেন। জানিয়েছিলেন, এই মেয়ে এক দিন তাঁদের মুখ উজ্জ্বল করবে। এ কথা বলতে বলতে এ দিন কেঁদে ফেললেন উজির।
অভাবের ঘর আজিজাদেরও। তার বাবা হুরমুজ শেখ এখন ট্রাক নিয়ে ভিন্ রাজ্যে। মেয়ের সাফল্যের খবর যখন তাঁর কাছে পৌঁছয়, তিনি পটনায় রয়েছেন। মা রশিদা বিবি বিড়ি বাঁধেন। সেই কাজে হাত লাগায় আজিজাও। যুগ্ম পঞ্চম হয়েছে মুর্শিদাবাদের সিয়াতুন নিসা। তার পরিবারেরও একই অবস্থা। বাবা রাজমিস্ত্রি। তাই লড়াই করে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে সিয়াতুন। ভাল ছাত্রী হিসেবে পরিচিত সে। পঞ্চম হওয়ায় পাড়ায় খুশির হাওয়া, কিন্তু সে মনে করছে, ‘‘আশা ছিল, আরও ভাল ফল হবে।’’
আজিজার সঙ্গে যুগ্ম তৃতীয় ওয়াকিল আনসারির বাবা মহম্মদ জাহিরুল ইসলাম একটি বেসরকারি নার্সারি স্কুল চালান। লকডাউনে স্কুল যখন বন্ধ ছিল, তখন রেশনের চাল ও গম ছিল তাঁদের খাবারের ভরসা। মেধাতালিকায় চতুর্থ রৌনাক জাহানের বাবা চাষি, মা অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী। যুগ্ম দশম আনজুমানারা খাতুনের বাবার একটি ছোট মুদিখানা দোকান আছে। লকডাউন তো বটেই, তার পরেও এই পরিবারগুলি দারিদ্রের মধ্যেই দিনযাপন করছে।
এদের মধ্যে ইমরানা আফরোজের অবস্থা কিছুটা ভাল। তার বাবা শিক্ষক। এক জায়গায় অবশ্য এই সব ক’টি পরিবারে এসে মিলে গিয়েছে। প্রায় সব ক’জন পড়ুয়াই চায় বড় হয়ে ডাক্তার হতে। বাড়ির লোকেরাও তাই চান। তবে সেই স্বপ্নের সিঁড়ি ধরে এগিয়ে যাওয়া যে জীবনের সব চেয়ে কঠিন পরীক্ষাগুলির অন্যতম, তা-ও জানেন সকলে।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy