দিলীপ ঘোষ, মুকুল রায়। ফাইল চিত্র।
বৈঠকে জোর বাদানুবাদ, তিক্ততা তুঙ্গে এবং সে সবের জেরেই দিল্লি ছেড়ে আচমকা কলকাতায় ফিরলেন মুকুল রায়। খবর বিজেপি সূত্রের। আর সেই খবরকে কেন্দ্র করেই ক্রমশ উত্তপ্ত রাজ্য বিজেপির অন্দরমহল। সংগঠনকে ‘কুক্ষিগত’ করার অভিযোগ তুলে দলের রাজ্য সভাপতির বিরুদ্ধে তোপ দাগতে শুরু করেছে উপদলে বহুধা গেরুয়া শিবির। দিলীপের সঙ্গে যাঁর মতপার্থক্য তুঙ্গে পৌঁছেছে বলে খবর, সেই মুকুল রায় কিন্তু লঘু করতে চেয়েছেন বিষয়টি। বাদানুবাদ প্রসঙ্গে তিনি মুখ খুলতে চাননি, চোখের চিকিৎসা তত্ত্বে জোর দিয়েছেন। তবে বঙ্গ বিজেপির সামনের সারির একাধিক মুখ যে ভাবে মন্তব্য এড়াতে চেয়েছেন বিষয়টি নিয়ে, তাতে দলের অন্দরের অস্বস্তি স্পষ্ট।
পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির সাংগঠনিক পরিস্থিতি, নির্বাচনী প্রস্তুতি এবং আরও কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য দিল্লিতে সপ্তাহব্যাপী বৈঠক ডাকা হয়েছে। দলের সর্বভারতীয় সহকারী সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) শিবপ্রকাশ এবং পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয়ই বৈঠক ডেকেছেন। তবে বৈঠকে কাদের ডাকা হবে বা কাদের ডাকা হবে না, সে সিদ্ধান্তের রাশ শুরু থেকেই রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ নিজের হাতে রাখতে চাইছিলেন বলে খবর। তা নিয়েই পরিস্থিতি গরম হতে শুরু করে। পরে আরও নানা বিষয় নিয়ে দিলীপ ঘোষ এবং মুকুল রায়ের মতপার্থক্য সঙ্ঘাতের চেহারা নেয় বলে জানা যাচ্ছে।
বুধবার থেকে বৈঠক শুরু হয়েছে দিল্লিতে। তবে বিজেপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে নয়। অশোক রোডে যে পুরনো কার্যালয় ছিল, সেখানেও নয়। এক এক দিন বৈঠক বসছে এক এক নেতার বাড়িতে। বুধবার বৈঠক বসেছিল দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তথা পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয়ের বাড়িতে। রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের সঙ্গে জাতীয় কর্মসমিতির সদস্য মুকুল রায়ের বাদানুবাদ সেখানেই তুঙ্গে পৌঁছয় বলে খবর। বৃহস্পতিবার বৈঠক বসে দিলীপ ঘোষের বাসভবনে। দিল্লিতে থাকা সত্ত্বেও সে বৈঠকে মুকুল রায় আর যোগ দেননি।
আরও পড়ুন: এতদিন পর নরসিংহ রাওকে শ্রদ্ধার্ঘ সনিয়া-রাহুলের, পিছনে কি অন্য রাজনীতি?
বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রথম দিনের বৈঠকে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনের সম্ভাব্য ফলাফল নিয়ে একটি সমীক্ষার রিপোর্ট সেখানে পেশ করেছিলেন শিব প্রকাশ। তাতে বাংলায় বিজেপির ১৯০টি আসন পাওয়ার সম্ভাবনার আভাস ছিল। কিন্তু জনমতের অবস্থা বাংলায় যেমনই হোক, বিজেপির সাংগঠনিক অবস্থা যে রকম, তাতে ওই আসনসংখ্যায় পৌঁছনো যাবে কি না, তা নিয়ে মুকুল সংশয় প্রকাশ করেন বলে বিজেপি সূত্রের খবর। সাংগঠনিক পরিস্থিতি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা হতেই দিলীপ শিবির অসন্তুষ্ট হয় বলে জানা গিয়েছে। ফলে যুক্তি-পাল্টা যুক্তির লড়াই শুরু হয়। এই মুহূর্তে ভোট হলে কত বুথে বিজেপি এজেন্ট বসাতে পারবে, ভোটার তালিকার পাতা ধরে ধরে ‘পৃষ্ঠা প্রমুখ’ (পন্না প্রমুখ) নিয়োগের কাজ কত দূর এগিয়েছে, এমন নানা বিষয় নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে। তর্ক ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে বলে খবর।
আরও পড়ুন: মানবদেহে করোনার টিকার প্রথম পরীক্ষা হল এইমসে
বৃহস্পতিবারের বৈঠকে মুকুল রায়ের যোগ না দেওয়া এবং শুক্রবার তাঁর কলকাতায় ফিরে আসা ঘিরে দলের অন্দরে গুঞ্জন তুঙ্গে। অমিত শাহের তলব পেয়ে মঙ্গলবার দুপুরে দিল্লি উড়ে গিয়েছিলেন মুকুল রায়। কেন্দ্রীয় নেতারা মুকুলকে বলেছিলেন, সপ্তাহব্যাপী বৈঠকেও হাজির থাকতে। কিন্তু এক দিন বৈঠক করেই যে ভাবে মুকুল ফিরে এসেছেন কলকাতায়, তাতে জল্পনা ছড়িয়েছে হু হু করে। শুধুমাত্র কয়েকটি বিষয়ে দিলীপের সঙ্গে মতপার্থক্যের কারণে মুকুল কলকাতায় ফিরে আসেননি বলে বিজেপির একটি অংশের দাবি। বঙ্গ বিজেপির এক সামনের সারির নেতার বিস্ফোরক অভিযোগ, ‘‘রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ এবং রাজ্য সংগঠন সম্পাদক সুব্রত চট্টোপাধ্যায় কুক্ষিগত করে রেখেছেন গোটা সংগঠন। দু’জন সাধারণ সম্পাদক এবং দু’জন সহ-সভাপতি ছাড়া আর কাউকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্তই করা হয়নি। দিল্লি যে নতুন রাজ্য কমিটি অনুমোদন করেছে, তার অধিকাংশ সদস্য-সদস্যাকে এখনও পর্যন্ত কোনও দায়িত্বই দেওয়া হয়নি। বৈঠকে তাঁদের ডেকে শুধু জানিয়ে দেওয়া হয়, কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সিদ্ধান্তের বিষয়ে তাঁদের কোনও মতামত নেওয়া হয় না। অন্যান্য দল ছেড়ে বিজেপিতে ঢোকা বড় বড় নামকে কাজই দেওয়া হয়নি।’’ ওই নেতার কথায়, ‘‘অনেক দিন ধরেই এ সব নিয়ে অসন্তোষ বাড়ছিল। বুধবারের বৈঠক উত্তপ্ত হতেই সে সব নানা প্রসঙ্গে সামনে চলে এসেছে বলে শুনেছি। ফলে বাদানুবাদ চরমে পৌঁছনো অস্বাভাবিক কিছু নয়।’’
মুকুল রায় নিজে কিন্তু এই বাদানুবাদ প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন শুক্রবার। আনন্দবাজার ডিজিটালকে তিনি বলেছেন, ‘‘ও সব কিছু হয়নি।’’ তা হলে বৈঠক অসম্পূর্ণ রেখে কলকাতায় ফিরে এলেন কেন? বৃহস্পতিবার দিল্লিতে থেকেও বৈঠকে যোগ দিলেন না কেন? মুকুল রায় বলেছেন, ‘‘প্রথম দিনের বৈঠকে নীতি নির্ধারণ সংক্রান্ত আলোচনা হয়েছে। আমি তাতে ছিলাম। তার পরের দিন থেকে জেলা ধরে ধরে আলোচনা হওয়ার কথা। সেই বৈঠকে আমার থাকার কোনও অর্থ হয় না। তা ছাড়া আমার চোখে ইঞ্জেকশন নেওয়ার বিষয়টাও ছিল। যে হেতু দিল্লিতে এখন থাকার কোনও প্রয়োজন নেই, আর চিকিৎসাটাও জরুরি, তাই ফিরে এলাম। পরে যখনই কোনও বৈঠকে যোগ দেওয়ার প্রয়োজন হবে, নেতৃত্ব যখনই আমাকে ডাকবেন, আবার যোগ দেব।’’
তবে মুকুলের এই অসাময়িক প্রত্যাবর্তন নিয়ে যে বিজেপির অন্দরে অস্বস্তি রয়েছে, তা হেভিওয়েটদের মন্তব্য এড়ানোর প্রবণতা থেকেও স্পষ্ট। রাজ্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু বলছেন, ‘‘মুকুলদার চোখে ইঞ্জেকশন নেওয়ার ব্যাপারটা যে রয়েছে, সেটা তিনি আগেই বলেছিলেন।’’ শুধু ইঞ্জেকশন নিতে কলকাতা চলে এলেন? দিলীপ ঘোষ তো অন্য ইঙ্গিতও দিচ্ছেন। করোনা সংক্রমণ এড়াতে এমনিতেই মুকুল রায় দূরে দূরে থাকছেন— এমন মন্তব্যও দিলীপ ঘোষ করেছেন। এই মন্তব্য কি একেবারেই নির্বিষ? নাকি এতে কোনও শ্লেষ রয়েছে? জবাব এড়িয়ে গিয়েছেন সায়ন্তন। তাঁর কথায়, ‘‘দিল্লিতে আর কী কী ঘটেছে, আমি এখনও ঠিক জানি না। আমি শনিবার দিল্লি যাব। তার পরে হয়তো জানতে পারব, আর কিছু ঘটেছিল কি না।’’
মন্তব্য এড়িয়েও সায়ন্তন যা বলেছেন, তা যথেষ্ট ইঙ্গিতবহ বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত। দিল্লিতে কোনও অপ্রীতিকর ঘটনাই ঘটেনি বা কোনও বাদানুবাদই হয়নি— এমন কথা বলে বিতর্ককে নস্যাৎ করার চেষ্টা সায়ন্তন করেননি। এখনও তিনি কিছু জানেন না, এই কথা বলে তিনি আসলে অস্বস্তিকর প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়েছেন, ব্যাখ্যা দলেরই একাংশের।
প্রায় একই পথে হেঁটেছেন আসানসোলের সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়। দিলীপ-মুকুলের ‘মন কষাকষি’ প্রসঙ্গে প্রশ্ন শুনেই তাঁর তড়িঘড়ি জবাব, ‘‘এ বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই।’’ সায়ন্তন বসু না হয় কলকাতায় রয়েছেন, দিল্লি গিয়ে জানতে পারবেন বলে জানিয়েছেন। বাবুল তো দিল্লিতেই রয়েছেন। সেখানে বসেও কিছুই জানতে পারলেন না? কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠরা মুচকি হাসছেন। আর দিল্লির সঙ্গে নিরন্তর যোগাযোগ রাখা এক যুবনেতা মন্ত্রীর মন্তব্যকে বিশ্লেষণ করে বলছেন, ‘‘বাবুল সুপ্রিয়ও কিন্তু বাদানুবাদ তত্ত্ব নস্যাৎ করলেন না। কিছু জানেন না বললেন ঠিকই। তবে ‘সব ভুয়ো খবর’বলে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টাও করলেন না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy