বন্ধ এনআরএস মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। মিলছে না কোনও পরিষেবাই। ছবি সৌজন্যে টুইটার।
গোটা রাজ্য জুড়ে স্তব্ধ স্বাস্থ্য পরিষেবা। বুধবার রাজ্যের প্রায় সমস্ত সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতালের আউটডোর পরিষেবা বন্ধ রয়েছে। অনেক জায়গায় বন্ধ জরুরি পরিষেবাও। যার জেরে চূড়ান্ত সমস্যায় পড়েছেন হাজার হাজার মানুষ। রোগী নিয়ে পরিবারের লোকজন ছুটে বেড়াচ্ছেন এ হাসপাতাল থেকে ও হাসপাতাল। কিন্তু কার্যত কোথাও মিলছে না ন্যূনতম চিকিৎসা পরিষেবা। কোনও কোনও জায়গায় জরুরি পরিষেবা মিললেও চিকিৎসকের সংখ্যা রয়েছে হাতে গোনা। রাজ্যের সর্বত্র চিকিৎসা পরিষেবা রীতিমতো বিপর্যস্ত। তার মধ্যেই বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে রোগীদের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে তীব্র সংঘর্ষ বাধে জুনিয়র ডাক্তারদের। নির্বিচারে চলে হকিস্টিক এবং ইটবৃষ্টি। নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে জুনিয়র ডাক্তারদের উপর হামলার প্রতিবাদে বুধবার রাজ্য জুড়ে ১২ ঘণ্টার আউটডোর পরিষেবা বন্ধের ডাক দিয়েছে চিকিৎসকদের যৌথ মঞ্চ।
সরকারি এবং বেসরকারি সব হাসপাতালেই ওই পরিষেবা বন্ধ রাখার সঙ্গেই চিকিৎসকদের কাছে আর্জি জানানো হয়েছিল ব্যক্তিগত চেম্বার বন্ধ রাখারও। তবে, জরুরি বিভাগ চালু রাখার চেষ্টা করা হবে বলে জানিয়েছিল ওই মঞ্চ। কিন্তু, এ দিন সকাল থেকেই গোটা রাজ্য নজিরবিহীন পরিস্থিতির সাক্ষী থাকল। সরকারি হোক বা বেসরকারি হাসপাতাল— কোথাও খোলা হল না আউটডোর। জরুরি বিভাগও বেশির ভাগ জায়গায় বন্ধ। চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারেও ঝুলছে তালা।
বেশির ভাগ হাসপাতালেই আউটডোর বিভাগ খোলা হয় সকাল ৯টায়। এ দিন সকালে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজের আউটডোর বিভাগের সামনে তার আগে থেকেই ভিড় জমতে শুরু করেছিল। কিন্তু সময় পেরিয়ে গেলেও আউটডোর খোলেনি। বেশ কয়েকটা জেলার মানুষ এই হাসপাতালের উপর নির্ভরশীল। প্রতি দিন হাজার হাজার মানুষ এই আউটডোরে ডাক্তার দেখান। কিন্তু এ দিন রোগীরা দীর্ঘ ক্ষণ দাঁড়িয়ে ফিরে যান। জরুরি বিভাগও কার্যত বন্ধ ছিল বলে রোগীর পরিবারের লোকজনের অভিযোগ।
বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে জখম জুনিয়র ডাক্তাররা।—নিজস্ব চিত্র।
একই পরিস্থিতি দেখা গিয়েছে মালদহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেও। খোলেনি আউটডোর। বন্ধ ছিল জরুরি পরিষেবাও। বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভর্তি থাকা রোগীদের দেখতে এসেছেন চিকিৎসকেরা। কিন্তু নতুন করে কোনও রোগী ভর্তি নেওয়া হয়নি বলে একাধিক অভিযোগ সামনে এসেছে।
এই দুই মেডিক্যাল কলেজ ছাড়াও উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা সদর হাসপাতাল এবং স্টেট জেনারেল হাসপাতালের অবস্থাও ছিল একই রকম।
উত্তরবঙ্গের পাশাপাশি দক্ষিণবঙ্গের চিত্রটাও একই রকম। মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, কল্যাণীর জওহরলাল নেহরু মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, সিউড়ি, বারাসত, হাবড়া, আরামবাগ, পুরুলিয়া, কৃষ্ণনগর, বহরমপুর— সর্বত্র একই ছবি। বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মঙ্গলবার রাত থেকেই উত্তপ্ত ছিল। সেখানে জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে রোগীর আত্মীয়দের গন্ডগোল বাধে। কর্তব্যরত চিকিৎসকদের মারধরের অভিযোগ ওঠে রোগীর আত্মীয়দের বিরুদ্ধে। ঘটনার রেশ ছিল এ দিন সকালেও। তার মধ্যেই বন্ধ রাখা হয় আউটডোর এবং জরুরি বিভাগ। এক প্রসূতিকে জরুরি বিভাগে নিয়ে আসা হয় বলে তাঁর পরিবারের দাবি। কিন্তু ঢুকতে বাধা দেন জুনিয়র ডাক্তাররা। এর পর দু’পক্ষে বচসা শুরু হয়। তার পরেই হাতাহাতি এবং মারামারি। পাথর ছোড়ার পাশাপাশি চলে হকিস্টিক, লাঠি দিয়ে মার। ঘটনায় দু’পক্ষেরই বেশ কয়েক জন আহত হয়েছেন। গুরুতর জখম হয়েছেন কয়েক জন জুনিয়র ডাক্তার।
জেলা হাসপাতালে কোনও সুরাহা না মেলায় অনেকেই কলকাতামুখী হয়েছিলেন। কিন্তু সেখানকার সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালেও বন্ধ ছিল আউটডোর। অনেক জায়গায় জরুরি বিভাগ খুললেও সেখানে ছিলেন না কোনও চিকিৎসক। এনআরএস মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এখনও কর্মবিরতি চালিয়ে যাচ্ছেন জুনিয়র ডাক্তাররা। চিকিৎসকদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার পাশাপাশি তাঁদের দাবি, প্রশাসনের শীর্ষকর্তাদের এ বিষয়ে আশ্বাস দিতে হবে। যত ক্ষণ না এ ব্যাপারে কোনও আশ্বাস তাঁরা পাবেন, তত ক্ষণ পর্যন্ত এই কর্মবিরতি চালিয়ে যাবেন বলে জানিয়েছেন ওই জুনিয়র ডাক্তাররা। ফলে বুধবারও এই হাসপাতালে চিকিৎসা পরিষেবা স্তব্ধ। বন্ধ আউটডোর। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে তালা ঝুলছে। জুনিয়র তো বটেই, হাসপাতালে দেখা মিলছে না সিনিয়র ডাক্তারদেরও।
সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল এসএসকেএম হাসপাতালেও এ দিন খোলেনি আউটডোর। হাসপাতালে আসা রোগীদের পরিবারের অভিযোগ, কোনও পরিষেবাই তাঁরা পাচ্ছেন না। চিকিৎসক কখন আসবেন জিজ্ঞাসা করায় হাসপাতাল থেকে উত্তর মিলছে, আজ কোনও পরিষেবা মিলবে না। ফলে আউটডোর থেকে বাধ্য হয়েই ফিরে যেতে হচ্ছে তাঁদের। এ দিন সকাল থেকেই হাসপাতালের সামনে রোগীদের ভিড় জমতে থাকে। কেউ এসেছিলেন মুর্শিদাবাদ, কেউ বাঁকুড়া, কেউ বা মালদহ— রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা রোগীর সংখ্যা প্রচুর।
আরও পড়ুন: দিনভর গাড়িতেই বসে, কেমো দেওয়া গেল না শিশুদের
একই সঙ্গে আউটডোর বন্ধ কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ, আরজি কর এবং ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজেও। এক হাসপাতালে পরিষেবা না পেয়ে অন্য হাসপাতালে ছুটছেন রোগী ও তাঁদের আত্মীয়েরা। কিন্তু শহরের প্রায় প্রতিটি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের ছবিই এক। বন্ধ আউটডোর। চিকিৎসকের সংখ্যা হাতে গোনা। ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে নিয়মমাফিক রাউন্ড দিয়েই তাঁরা বেরিয়ে যাচ্ছেন হাসপাতাল থেকে।
শহরের একের পর এক বেসরকারি হাসপাতালে বন্ধ রয়েছে আউটডোর। কোথাও কোথাও জরুরি পরিষেবাও বন্ধ রাখা হয়েছে। শহরের একটি নামী বেসরকারি হাসপাতালের এক চিকিৎসক এ দিন বলেন, ‘‘আমাদের হাসপাতালে আউটডোর বন্ধ। জরুরি বিভাগ খোলা রয়েছে। কেউ শ্বাসকষ্ট বা বুকে ব্যথা নিয়ে এলে চিকিৎসকেরা দেখছেন। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপও করা হচ্ছে। কিন্তু, সাধারণ কোমর ব্যথা বা ওই জাতীয় সমস্যা নিয়ে এলে আজ কোনও পরিষেবা মিলছে না।’’
হাসপাতালের আউটডোরে পরিষেবা না পেয়ে অনেকেই চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে গিয়েছিলেন। কিন্তু সে সব চেম্বার এবং ক্লিনিকও বন্ধ রয়েছে বলে অভিযোগ করছেন রোগীর পরিবারের আত্মীয়রা। এমনকি, মনোরোগ বা বন্ধ্যাত্ব বিষয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা চিকিৎসকরাও বন্ধ রেখেছেন চেম্বার এবং ক্লিনিক। শহরের একটি ইনফার্টিলিটি ক্লিনিকের এক চিকিৎসক বলেন, ‘‘আমাদের এখানে আজ কোনও ডাক্তারই রোগী দেখছেন না। তবে, কোনও প্রসূতি যদি রক্তপাত বা গুরুতর সমস্যা নিয়ে আসেন, তাঁর জন্য জরুরি ব্যবস্থা রয়েছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy