হাওড়া কদমতলা তারাসুন্দরী বালিকা বিদ্যাভবনের ‘বড়দি’ মোনালিসা মাইতি। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
উৎসব নেই। পুজোও নেই ধারেকাছে। কারণ, তিনিই পুজো এবং উৎসবের ধারেকাছে নেই।
ঢাকের আওয়াজ, ধূপধুনোর গন্ধ আটকাতে খিল দিয়েছেন মনের দরজায়। হাতে তাঁর রবীন্দ্রনাথের ‘গীতবিতান’। কবিকে নিয়েই পুজো কাটাচ্ছেন হাওড়ার দিদিমণি। কদমতলার তারাসুন্দরী বালিকা বিদ্যাভবনের ‘বড়দি’ মোনালিসা মাইতি। বলছেন, ‘‘এই আন্দোলনটাই উৎসব। সমাজ শোধনের উৎসব। নিজের সঙ্গে নিজের দেখা হওয়ার মহোৎসব।’’ খ্যাতি না চাইলেও পেয়ে গিয়েছেন। সেই খ্যাতি বাড়িয়ে দিয়েছে জেদ। সকলের কাছে উদাহরণ হওয়ার জেদ। জানালেন, এ বারের পুজোয় তাঁর মন্ত্র জুগিয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান— ‘মোরা সত্যের ’পরে মন আজি করিব সমর্পণ।’
মোনালিসার জন্ম ঐতিহাসিক ভাবে আন্দোলনের ভূমি নন্দীগ্রামে। সেখানকারই চিল্লোগ্রামে রয়েছে পৈতৃক বাড়ি। তবে লেখাপড়া, বেড়ে ওঠা হলদিয়ায়। বাবার চাকরি ছিল হলদি-পারের শহরে। মোনালিসা নামটা এখন আর খুব পছন্দের নয়। তবে ছেলেবেলায় খুব ভাল লাগা ছিল। আশির দশকের গোড়ায় হলদিয়া শহরে এমন আধুনিক নাম আর ক’টাই বা ছিল! ছবি আঁকিয়ে বাবা যামিনীকান্ত মাইতি সম্ভবত লিওনার্দো দা ভিঞ্চির অনুরাগী ছিলেন বলেই মেয়ের সেই নামকরণ। কিন্তু কলেজে ঢুকতেই বন্ধুদের মুখে ‘মোনা ডার্লিং’ হয়ে যাওয়াটা পছন্দ হয়নি। বড় হওয়ার পরে মনে হয়, ‘মোনালিসা’ মানেই যেন হোটেল বা বিউটি পার্লারের নাম।
শিক্ষিকা হতে চেয়েছিলেন মোনালিসা। হলদিয়ার বেসিক ট্রেনিং স্কুল, মহিষাদলের এক স্কুলে সহকারী শিক্ষিকা থাকার পরে নন্দীগ্রামের বি এম গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। ২০২১ সালে বদলি নিয়ে হাওড়ায়। এখন থাকেনও এই জেলাতেই। তবে পুজোর স্মৃতি ছড়িয়ে রয়ে গিয়েছে শৈশবের নন্দীগ্রাম, হলদিয়া থেকে বৌ হয়ে যাওয়া মালদহের হলদিবাড়িতে। চুলের খোঁপা, নতুন শাড়ি, নতুন জুতোয় ফোস্কা-পড়া পা নিয়ে ঠাকুর দেখা সব ছিল। কিন্তু এ বার কিছু নেই। স্মৃতির মুগ্ধতা, উল্লাস, কাশফুল, শিউলি ভুলে মনে এখন শুধু সন্তাপ। আরজি করের নির্যাতিতা চিকিৎসকের জন্য যে সন্তাপের জন্ম, তা এখন চারিয়ে গিয়েছে তাঁর যাপনের প্রতিটি মুহূর্তে। তাই পুজোর ছুটিতে দিদিমণি ছুটি দিয়েছেন পুজোকেই।
লেখাপড়ার পাশাপাশি ছাত্রীদের ঋজু শিরদাঁড়া তৈরিও শপথ মোনালিসার। এ বারের পুজো, আলো, ঢাক মিলিয়ে গোটা আবহ তাঁর কাছে বিষের মতো। সেই বিষ বুকে জমিয়ে রেখে আগামীর জন্য অমৃত পেতে চান। নিজে অবশ্য এত কথা বলেননি। শুধু বলেছেন, ‘‘অমৃত না-ই বা মিলল, আমরা কেউ কেউ যেন সমাজ থেকে বিষটুকু তুলে নীলকণ্ঠ হতে পারি।’’
সরকারি হাসপাতালে ধর্ষণ আর খুনের খবর কাঁপিয়ে দিয়েছিল তাঁকে। ঘুম হচ্ছিল না ঠিকঠাক। মুখে রুচি ছিল না। ১৪ অগস্ট রাত দখলের উদ্দীপনা দেখে বেড়ে যায় জেদ। এত মানুষ রাস্তায় নেমেছেন দেখে মনে হয়, মোমবাতি নয়, মশাল জ্বালতে হবে। প্রতি দিন স্কুল শুরুর আগে প্রার্থনার সময় ছাত্রীদের চারপাশের খবর শোনান তিনি। আরজি কর-কাণ্ড নিয়েও ক’দিন বলেছিলেন। এক দিন উঁচু ক্লাসের মেয়েরা বলে, ‘‘বড়দি, আমরা মিছিল করতে চাই। মৌনীমিছিলে প্রতিবাদ জানাতে চাই।’’
প্রতিবাদের যে ভাষা তিনিই শিখিয়েছেন, তা ছাত্রীদের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হতে শুনে প্রথমে থতমত খেয়ে গিয়েছিলেন মোনালিসা। তাঁর কথায়, ‘‘ওদের কথাগুলো আবদার বা আর্জি নয়, নির্দেশ মনে হল। সকলের সঙ্গে আলোচনা করে অনুমতি দিলাম। কিন্তু বাচ্চাগুলো একা যাবে নাকি! আমরাও সঙ্গে বার হলাম।’’ সে দিন ছিল ১৯ অগস্ট, সোমবার। বাজারের মধ্য দিয়ে সেই প্রতিবাদ মিছিল দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন পথচলতি মানুষ। মোনালিসার বলা কথা ভিডিয়ো হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। সে দিন থেকেই মোনালিসা মানে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। পরিপাটি করে পরা শাড়ি আর লাল টিপের তারাসুন্দরীর বড়দিকে চিনে ফেলেছিল গোটা বাংলা।
প্রধানশিক্ষিকার থেকেও বেশি করে ‘মা’ হতে চেয়েছেন কি মোনালিসা? না হলে স্কুলের ছাত্রীদের ‘বাচ্চা’ বলে সম্বোধন করেন কেন? বললেন, ‘‘এই উচ্চারণে ছেলে-মেয়ে ভাগ নেই।’’ মোনালিসা এ-ও মনে করেন যে, ‘‘বাচ্চার দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ছুটে যান যে মা, তিনিও আসলে পুরুষ। আবার মেয়েদের জন্য অনেক লড়াই করেও শেষ জীবনে নির্বাসনে যাওয়া বিদ্যাসাগর আসলে ‘মা’ হয়ে উঠেছিলেন।’’
কোনও কালেই ‘মিষ্টি মেয়ে’ ছিলেন না। নিজেই সেটা গর্ব করে বলেন। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে গৃহশিক্ষকের দায়িত্বপালন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। মায়ের কাছে মারও খেয়েছিলেন। তারও আগে বছর সাতেক বয়সে জেদি মেয়ে পছন্দের কবিতা সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘ছাড়পত্র’ আবৃত্তি করা যাবে বলে প্রতিযোগিতায় সর্বসাধারণ বিভাগ বেছে নিয়েছিলেন। ছোট হয়েও বড়দের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামা মোনালিসাকে সান্ত্বনা পুরস্কার দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন আয়োজকরা। শুনে রাগে পুরস্কার নেয়নি সে মেয়ে! তবে বাবার কাছে অনেক আদর পেয়েছিল।
মেয়েবেলা থেকে জেদি সত্তা বহন করা মোনালিসা ‘উৎসব নয়’ সিদ্ধান্ত ছড়িয়ে দিয়েছেন তাঁর স্কুলের সহকর্মী থেকে শুরু করে ছাত্রীদের মধ্যেও। স্কুলে এ বার ‘শিক্ষক দিবস’ পালিত হয়নি। পুজোর ছুটি পড়ার আগের দিন প্রতি বার মেয়েরা, দিদিমণিরা নতুন পোশাক পরে আসেন স্কুলে। এ বার হয়নি। হতে দেয়নি সর্বজনীন সন্তাপ।
সেই সন্তাপ বুকে নিয়ে মোনালিসা নিজের মুখোমুখি হওয়ার মণ্ডপ গড়েছেন তাঁর একলা ঘরে। সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ। মন্ত্রের মতো জপছেন, ‘‘যদি দুঃখে দহিতে হয় তবু নাহি ভয়, নাহি ভয়। যদি দৈন্য বহিতে হয় তবু নাহি ভয়, নাহি ভয়। যদি মৃত্যু নিকট হয় তবু নাহি ভয়, নাহি ভয়।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy