Advertisement
E-Paper
BB_2025_Lead Zero Banner

‘আমার জীবনে পুজো বলে আর কিছু নেই, থাকবেও না’, বিক্রমের ছবি আঁকড়ে দিন গুজরান মা কবিতার

পুজো আছে। বিক্রম নেই। বিক্রমের ছবি আঁকড়ে মা কবিতা বলছেন, ‘‘আমার জীবনে পুজো বলে আর কিছু নেই। আর কিছু থাকবেও না। কোনও দিন না।’’

Puja days of Family of Bikram Bhattacharya family, who died at RG Kar Hospital due to an accident

ছেলে বিক্রমের ছবি হাতে মা কবিতা। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।

শোভন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০২৪ ০৭:৫০
Share
Save

যতটা ঘর, প্রায় ততটা জুড়েই খাট। খাটের এক পাশে আলনা। সেই আলনায় ঝোলানো কিছু ঘরে পরার কাপড়। সেই কাপড়ের উপর রাখা মলিন হয়ে যাওয়া গোলাপি টেডি বেয়ার। অন্যান্য বার পুজোর সময়ে এই আলনাতেই রাখা থাকত নতুন পোশাক বা নতুন পোশাকের ব্যাগ। এ বার নেই। কারণ, যিনি নিজের এবং পরিবারের সকলের জন্য নতুন জামা কিনতেন, তিনিই নেই। আলনার উপর সবুজ রঙের দেওয়ালে ঝুলছে তাঁর ছবি।

বিক্রম ভট্টাচার্য।

হুগলির কোন্নগরের জোড়াপুকুর এলাকার বাসিন্দা বিক্রম সেপ্টেম্বরের গোড়ায় পথ দুর্ঘটনায় গুরুতর জখম হয়েছিলেন। রক্তাক্ত বিক্রমকে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সাত কিলোমিটার দূরের শ্রীরামপুর ওয়ালশ হাসপাতালে। পরিস্থিতি তখনই সঙ্কটজনক। ওয়ালশ তাঁকে ‘রেফার’ করে আরজি করে। চিকিৎসক তরুণীকে ধর্ষণ এবং খুনের প্রতিবাদে তখন জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতি চলছে। আরজি কর হাসপাতালেই মৃত্যু হয় ২৮ বছরের বিক্রমের। বিক্রমের মা কবিতা দাস হাসপাতালের চত্বরে দাঁড়িয়েই বিলাপ করেছিলেন, ‘‘ডাক্তারবাবুরা যদি একটু দেখতেন, ছেলেটাকে একটু রক্ত দেওয়া যেত, ছেলেটা মরে যেত না।’’

পঞ্জিকার নিয়ম মেনে অন্যান্য বারের মতো বিক্রমের পরিবারের দোরগোড়াতেও পুজো এসেছে। কিন্তু বিক্রম নেই। ছেলের ছবি আঁকড়ে মা কবিতা বলছেন, ‘‘আমার জীবনে পুজো বলে আর কিছু নেই। আর কিছু থাকবেও না। কোনও দিন না।’’

হুগলি জেলায় যে যে অঞ্চল উদ্বাস্তু কলোনি এলাকা বলে পরিচিত, তার মধ্যে অন্যতম কোন্নগরের জোড়াপুকুর। সেই কলোনিতেই বিক্রমদের টালির চালের বাসা। সেই টালির চালেও বিভিন্ন জায়গায় প্লাস্টিকের তাপ্পি। কোনওটা নীল, কোনওটা সাদা-কালো ডোরাকাটা। সামনে একচিলতে উঠোন। আর্থিক ভাবে ‘প্রান্তিক’ বিক্রমের পরিবার।

উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর আর পড়াশোনা এগোতে পারেননি বিক্রম। শিখেছিলেন গাড়ি চালানো। সেটাই হয়েছিল তাঁর পেশা। প্রাইভেট গাড়ি থেকে মালবাহী ছোট গাড়ির চালক হিসাবেই জীবিকা নির্বাহ করতেন বিক্রম। তবে তাঁর দুর্ঘটনা ঘটেছিল মোটরসাইকেল চালানোর সময়। কবিতার প্রথম স্বামীর সন্তান বিক্রম। বিবাহবিচ্ছেদের পর কবিতা সংসার করছেন সুজিত দাসের সঙ্গে। বিক্রমের মৃত্যুর পরে হাসপাতাল, থানা-পুলিশ, প্রশাসনে ছোটাছুটি করতে হয়েছে সুজিতকেই। সৎপুত্র বিক্রমের পারলৌকিক কাজও করেছেন সুজিতই। অন্যের টোটো চালাতেন সুজিত। পরিবারে বিপর্যয়ের পর সেই কাজ কামাই হয়েছে। তাই তাঁর কাজও চলে গিয়েছে। সুজিত বলছিলেন, ‘‘ছেলেটাও চলে গেল। আমার কাজটাও রইল না। পুজোর আগে পুরো ঘরে বসা।’’ হোসিয়ারি শিল্পে ছোটখাটো কাজ করেন কবিতা। তাঁদের সংসারে অভাব প্রকট। টালির চালে প্লাস্টিকের তাপ্পি, ঘরের ভিতরের চালের ঝুল-ধরা বাঁশ তার সাক্ষী। পুজোয় সন্তানশোক তো আছেই। পাশাপাশি দাস পরিবারে মিশে গিয়েছে দৈনন্দিন অনটনও।

এলাকায় ‘ভিকি’ নামে পরিচিত ছিলেন বিক্রম। জোড়াপুকুর মোড়ে মুড়ি-ঘুগনির দোকানে খোঁজ করতে তাঁদের বাড়ি দেখিয়ে দিলেন এক ভ্যানচালক। তার পরে স্বগতোক্তির মতো বলে উঠলেন, ‘‘মরা ছেলেটা নামেই থেকে গেল!’’ প্রতি বার পুজোর সপ্তাহখানেক আগে ‘বোনাস’ পেতেন বিক্রম। মাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েই সকলের জন্য নতুন পোশাক কিনতেন। এ বারের পুজোয় তিনি ফ্রেমে বন্দি হয়ে দেওয়ালে ঝুলছেন।

বিক্রমের পুজোর অতীতচারণ করতে গিয়ে ডুকরে ডুকরে উঠছিলেন কবিতা। বলছিলেন, ‘‘পুজোয় বেশির ভাগ সময়েই গাড়ি চালিয়ে লোকজনকে কলকাতায় ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যেত ভিকি। ফিরে এসে আমায় ছবি দেখাত।’’ বেশির ভাগ সময় দিদার কাছেই থাকতেন বিক্রম। সত্তরোর্ধ্ব সেই বৃদ্ধাও শোকে পাথর। মাস ঘুরে গিয়েছে। কিন্তু এখনও তিনি অসংলগ্ন কথা বলেন। সন্তানশোক, অভাবের সঙ্গে কবিতার সংসারে রয়েছেন তাঁর মা-ও। যিনি এখনও বিক্রমের চলে যাওয়ার শোক সামলে উঠতে পারেননি। যিনি রোজ দু’বেলা তাঁর ‘দাদুভাই’য়ের ছবি ঝেড়েমুছে রাখেন। মলিন টেডিবেয়ার, পুরনো পোশাকের আলনার পাশে সে ছবি যত্নের কারণ ঝকঝক করছে। কিন্তু তাতে কোনও প্রাণ নেই।

কবিতা বলছিলেন, ঢাকের আওয়াজ তাঁর কানে বিষমাখানো তিরের ফলার মতো। উৎসবের আলো তাঁর চোখ ঝলসে দিচ্ছে। এমন এক ‘ভিন্ন পুজো’ যে কোনও দিন কাটাতে হবে, তা তিনি ভাবতে পারেননি। যেমন ভাবতে পারেননি ঘুগনি-মুড়ি খেতে থাকা ভ্যানচালক। পুজোর সময়ে প্রতি বছরই সামর্থ্য অনুযায়ী বিক্রমদের বাড়িতেও ভালমন্দ খাওয়া হত। এখন পরিবারের তিন জনই খান। শুধু পেট ভরাতে।

অনেকে বলেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শোক সয়ে যায়। কিন্তু বিক্রমের মা বলছেন, ‘‘চোখের সামনে ছেলেটাকে মরতে দেখেছি। ট্রলিতে শুয়ে কাতরাতে কাতরাতে বলেছিল, একটু রক্ত দিতে বলো না মা! একটু রক্ত দিতে বলো! ওরা শোনেনি।’’ চোখের জল মুছতে মুছতে কবিতা বলেন, ‘‘সে দিন যদি একটু রক্ত দেওয়া যেত, ছেলেটা বেঁচে যেত। হয়তো প্রতিবন্ধী হয়ে থাকত। তবু বেঁচে তো থাকত!’’

পাড়ায় পুজো আছে। আলো আছে। বিক্রমের ডাকনামে পরিচিতিও রয়েছে। তবে বাকি সব ওলটপালট হয়ে গিয়েছে। পুরনো পোশাক রাখা আলনা দাঁড়িয়ে আছে ধ্বংসস্তূপের অভিজ্ঞান হয়ে। উপরে ফ্রেমবন্দি বিক্রমের ছবি। ঝকঝকে। কিন্তু নিষ্প্রাণ।

R G kar Incident patient death Durga Puja 2024 Bhinno Pujo Konnagar

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।