সারদা-কাণ্ডে সিবিআই-তদন্তের জেরে মাসখানেক যাবৎ যথেষ্ট অস্বস্তিতে রয়েছে রাজ্যের শাসক দল। বুধবার পাড়ুই-কাণ্ডে কলকাতা হাইকোর্টের রায় সে অস্বস্তি আরও বাড়িয়ে দিল। রাজ্য পুলিশের বিশেষ তদন্ত দলের (সিট) উপরে সম্পূর্ণ অনাস্থা প্রকাশ করে সাড়া জাগানো ওই হত্যা-মামলার তদন্তভার এ দিন সিবিআইয়ের হাতে সঁপেছে হাইকোর্ট। রাজ্য পুলিশের ডিজি-কে মাথায় রেখে হাইকোর্টেরই গড়ে দেওয়া পাড়ুই-সিটের তদন্তকে রাজ্য সরকার যে প্রতি পদে প্রভাবিত করেছে, বিচারপতি হরিশ টন্ডন তা-ও জানাতে কসুর করেননি। “মূল অভিযুক্তকে বাঁচাতে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো হয়েছে।” নির্দেশে স্পষ্টই বলেছেন তিনি।
মূল অভিযুক্ত, অর্থাৎ অনুব্রত মণ্ডল। তৃণমূলের এই বীরভূম জেলা সভাপতির নাম পাড়ুই-পর্বে ঘুরে-ফিরে উঠে এসেছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে যাঁর একমঞ্চে থাকা নিয়ে আগে প্রশ্নও তুলেছে আদালত। এবং এ দিনও আদালতের পর্যবেক্ষণ, পাড়ুই-তদন্তে অনুব্রতকে আড়াল করতে রাজ্য প্রথম থেকে চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে। বস্তুত পাড়ুই-তদন্তে রাজ্য পুলিশের ডিজি-র ভূমিকার যে রকম সমালোচনা এ দিন হাইকোর্টের মুখে শোনা গিয়েছে, তাতে নবান্ন রীতিমতো বিব্রত। রাজ্য পুলিশবাহিনীর প্রধানের নিরপেক্ষতা নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে আদালত। “ডিজি’র উপরে আদালত যে আস্থা রেখেছিল, তা ভেঙেচুরে খান খান হয়ে গিয়েছে।” আক্ষেপ করেছেন বিচারপতি।
এমতাবস্থায় পাড়ুই-মামলার কাগজপত্র অবিলম্বে সিবিআইয়ের হাতে তুলে দিতে সিট-কে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। বিচারপতির নির্দেশ, হাইকোর্টের তত্ত্বাবধানে সিবিআই তদন্ত করবে। হাইকোর্টকে নিয়মিত রিপোর্ট দিয়ে জানাবে, তদন্ত কত দূর এগোল। ওই নির্দেশে স্থগিতাদেশ চেয়েছিলেন সরকারপক্ষের কৌঁসুলি কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। বিচারপতি টন্ডন তা-ও খারিজ করে দিয়েছেন। সারদা-কাণ্ডে ‘বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের’ শিকড় খুঁজতে কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো ইতিমধ্যে কার্যত তৃণমূলের অন্দরে ঢুকে পড়েছে। এ দিনই তৃণমূলের সাংসদ-যুবনেতা শুভেন্দু অধিকারীকে সিবিআই তলব করেছিল, যা নিয়ে তৃণমূল নেতৃত্ব এমনিতেই উদ্বেগে ছিলেন। “শুভেন্দু সিবিআই দফতরে হাজির হওয়ার আগেই হাইকোর্টের এ হেন পাড়ুই-নির্দেশ দল তথা সরকারের উৎকণ্ঠা বেশ কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিল।” বলেন প্রশাসনেরই এক কর্তা।
নবান্ন-সূত্রের খবর, এ দিনের রায়ের বিরুদ্ধে পুজোর ছুটির আগেই রাজ্য সরকার হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে আবেদন করতে পারে। যদিও তাতে সরকারের বর্তমান বিড়ম্বনা ঢাকা পড়ার সম্ভাবনা কম। সাম্প্রতিক বিভিন্ন মামলার তদন্তে হাইকোর্ট পুলিশি গাফিলতি নিয়ে সরব হয়েছে। পুলিশ-সিআইডি’র গাফিলতির যুক্তিতে গুড়াপ ও ধনেখালি-কাণ্ডে সিবিআই-তদন্তের নির্দেশও দিয়েছে। কিন্তু এ দিন পাড়ুই-প্রসঙ্গে বিচারপতি টন্ডন যে ভাষায় রাজ্য পুলিশের ডিজি-র ভূমিকার সমালোচনা করেছেন, তার কোনও উদাহরণ সাম্প্রতিক অতীতে নেই বলেই দাবি করেছেন হাইকোর্টের আইনজীবীদের একাংশ।
গত বছরের ২১ জুলাই, রাজ্যে চতুর্থ দফার পঞ্চায়েত ভোটের আগের রাতে বীরভূমের পাড়ুইয়ের কসবা গ্রামের বাঁধ নবগ্রামে খুন হন অবসরপ্রাপ্ত স্কুলকর্মী সাগর ঘোষ, যাঁর ছেলে হৃদয় ঘোষ নির্বাচনে নির্দল প্রার্থী হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। পুত্রবধূ শিবানীদেবীর অভিযোগ ছিল, শ্বশুরমশাইকে আহত অবস্থায় ফেলে রেখে পুলিশ জবরদস্তি তাঁদের দিয়ে সাদা কাগজে সই করিয়ে নেয়। এবং তাতে ক’জনের নাম লিখে তাদের গ্রেফতার করে। আসল অপরাধীদের আড়াল করা হয়। পরে তিনি জেলার এসপি এবং অন্য পুলিশ আধিকারিকদের চিঠি দিয়ে ঘটনাটি জানান। চিঠিতে তিনি মূল অভিযুক্ত হিসেবে অনুব্রত ও বীরভূম জেলা পরিষদের তৃণমূল সভাধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরীকে চিহ্নিত করেন। যদিও পুলিশ তাতে আমল দেয়নি। অনুব্রত-বিকাশ এখনও অধরা।
সাগর-হত্যার পুলিশি তদন্তে অনাস্থা প্রকাশ করে পরে হাইকোর্টে মামলা হয়, যাতে শিবানীদেবীও সামিল হয়ে সিবিআই-তদন্ত দাবি করেন। হাইকোর্টের বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত রাজ্য পুলিশের ডিজি-র নেতৃত্বে সিট গড়ে দেন। শিবানীদেবীর অভিযোগপত্রকেই এফআইআর হিসেবে গণ্য করে সিট’কে তদন্ত চালাতে বলেন তিনি। ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে দিয়ে পাড়ুই-মামলা শেষমেশ চলে আসে বিচারপতি হরিশ টন্ডনের এজলাসে। সিট-তদন্তের রকম-সকম দেখে তিনিও সন্তুষ্ট হতে পারেননি। নানান প্রশ্নের উত্তর পেতে তিনি সিটের প্রধান, অর্থাৎ ডিজি’কে তলব করেছিলেন। ডিজি জিএমপি রেড্ডি গত ৪ সেপ্টেম্বর আদালতে হাজির হয়ে জানান, পাড়ুই-হত্যায় অনুব্রত মণ্ডলের কোনও ভূমিকা তাঁরা খুঁজে পাননি। বিচারপতি টন্ডন সে দিন এ প্রসঙ্গে মন্তব্য না-করলেও এ দিন রায় দিতে গিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন, ডিজি রাজ্য সরকারের অনুগত হয়েই কাজ করেছেন, রাজধর্ম পালন করেননি।
আদালতের রায় সম্পর্কে ডিজি-র প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। বারবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। এসএমএসের জবাব দেননি। অবশ্য সাগরবাবুর পরিবার খুশি। “আদালত ন্যায় বিচার করেছে।” বলেছেন হৃদয়বাবু। রায় শুনে অনুব্রতের মন্তব্য, “আমি কোনও অন্যায় করিনি। আইন আইনের পথে চলবে।” সরকারের তরফে তৃণমূলের মহাসচিব তথা শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় মন্তব্যে করতে চাননি। তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, “আদালতের নির্দেশ নিয়ে কী মন্তব্য করব? সিবিআই’কে তো আগেও বহু মামলার তদন্তভার দেওয়া হয়েছে। কোনটার নিষ্পত্তি করতে পেরেছে?” তাঁর সংযোজন, “কোর্ট তো সিবিআই’কে খাঁচাবন্দি তোতা বলেছিল! এখন তাকেই দায়িত্ব দিতে বলেছে!”
বিরোধীরা অবশ্য হাইকোর্টের রায়কে হাতিয়ার করতে দেরি করেনি। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের প্রতিক্রিয়া, “সরকারের উচিত হাইকোর্টের নির্দেশ মেনে নেওয়া। কিন্তু এরা এতটাই নির্লজ্জ যে, আবার উচ্চ আদালতে যাবে!” সূর্যবাবুর পর্যবেক্ষণ, “সারদায় সিবিআই রুখতে গিয়ে রাজ্য ১১ কোটি টাকা খরচ করেছে! আদালতে অপদস্থ হচ্ছে, আর আইনজীবীদের ফি দিচ্ছে! তার মধ্যে শাসকদলের আইনজীবীও আছেন! এই টাকা জনগণের করের টাকা! সরকারের লজ্জা পাওয়া উচিত!” পাশাপাশি আইনজীবীদের অনেকের মতে, হাইকোর্ট যে ভাবে খোদ ডিজি’র নিরপেক্ষতার দিকে আঙুল তুলেছে, রাজ্যের গোটা পুলিশবাহিনীর উপরে তার প্রভাব পড়তে পারে।
বিচারপতি টন্ডন তাঁর রায়ে বলেছেন, ডিজি’র তদন্তকে রাজ্য সরকার আগাগোড়া প্রভাবিত করেছে। মূল অভিযুক্তকে বাঁচাতে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো হয়েছে। উপরন্তু বিচারপতির পর্যবেক্ষণ: হৃদয়বাবুর কাছে অনেক তথ্য থাকা সত্ত্বেও তাঁর বিবৃতি সিট পুরোপুরি অবজ্ঞা করেছে। গত ৩০ এপ্রিল মামলার তদন্তকারী অফিসারের (আইও) দাখিল করা রিপোর্টকে সম্পূর্ণ বিকৃত বলে অভিহিত করেছে আদালত। ডিজি এজলাসে জানিয়েছিলেন, শিবানীদেবী ছাড়া আর কেউ অনুব্রতের নাম উল্লেখ করেননি। এ দিন বিচারপতির বক্তব্য: হৃদয়বাবু পুলিশের কাছে যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনুব্রতের নামও যে রয়েছে, ডিজি তা কোর্টকে জানাননি।
অসন্তোষ আরও রয়েছে। আদালতের বক্তব্য: হাইকোর্ট সিট গড়ে ডিজি’কে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিল, তদন্তের ক্ষেত্রে ডিজি রাজ্যের আইনি পরামর্শ নেবেন না, রাজ্যও আগ বাড়িয়ে ডিজি’কে সাহায্য করবে না। সিট-কে বলা হয়েছিল তদন্তের অগ্রগতি-রিপোর্ট সব সময় মুখবন্ধ খামে হাইকোর্টে জমা দিতে। অথচ সরকারি কৌঁসুলির সওয়ালে এমন সব কথা শোনা গেল, যা কি না ডিজি-র রিপোর্টে রয়েছে! উপরন্তু ডিজি নিজে আদালতে এসে জানিয়ে গেলেন, তিনি নিম্ন আদালতে মামলার চার্জশিট পেশের আগে সরকারি আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করেছেন!
এমন নানা কারণে ডিজি’র উপরে আদালতের আস্থা চুরমার হয়ে গিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিচারপতি। বিস্ময়ের সঙ্গে তাঁর পর্যবেক্ষণ, সিট-প্রধান ৩০ এপ্রিল আদালতে রিপোর্ট পেশ করে জানিয়েছিলেন, খুনের পিছনে রয়েছে একটি রাজনৈতিক দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, যা বেশ বড় ধরনের। তবু ডিজি অনুব্রতকে একেবারে ‘ক্লিন চিট’ দিলেন! এবং তার কারণ হিসেবে যুক্তি দিলেন, অনুব্রতই নাকি সিট’কে বলেছেন যে, সাগর-হত্যার রাতে তিনি নিজের বাড়িতে ছিলেন, এতে তার কোনও হাত নেই! অনুব্রত নির্দল প্রার্থীদের বাড়ি জ্বালানো ও পুলিশের দিকে বোমা ছোড়ার মতো উস্কানিমূলক কথাবার্তা প্রকাশ্যে বললেও তাঁর সেই বক্তৃতাকে সিট কেন আমল দিল না, আদালত সে প্রশ্ন তুলেছে। তা ছাড়া, সাগর-খুনের ৬ মাস ২০ দিন বাদে ফরেন্সিক দল ঘটনাস্থলে গিয়েছিল। এর থেকেই সিট-তদন্তের গতি-প্রকৃতি পরিষ্কার বোঝা গিয়েছে বলে মন্তব্য করেছে হাইকোর্ট।
রায় ঘোষণার পরে শিবানীদেবীর কৌঁসুলি ফিরোজ এডুলজি বলেন, “খুনের ঠিকঠাক তদন্ত হয়নি। তাই সিবিআই-তদন্ত চেয়ে মামলা করা হয়েছিল। বিচারপতি সঠিক তদন্তের স্বার্থেই সিবিআইয়ের হাতে মামলা তুলে দিতে বলেছেন।” ফিরোজের দাবি, “ডিজি-র এখনই পদত্যাগ করা উচিত।” হৃদয়বাবুর কৌঁসুলি শীর্ষেন্দু সিংহরায় জানান, এই রায়ের বিরুদ্ধে রাজ্য ডিভিশন বেঞ্চে গেলে প্রয়োজনে তাঁরা সুপ্রিম কোর্টে যাবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy