কলকাতা পুরভোটে সন্ত্রাস নিয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের দেওয়া প্রাথমিক রিপোর্ট মোটেই পছন্দ হয়নি রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীর। নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়কে সে কথা জানিয়ে তাঁর কাছে নতুন রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছেন ক্ষুব্ধ রাজ্যপাল। নির্বাচনী গোলমাল নিয়ে কোনও রাজ্যপালের এত কড়া মনোভাব নজিরবিহীন বলেই মনে করছেন রাজ্য প্রশাসনের একাধিক পদস্থ কর্তা।
কলকাতা পুরভোটে শাসক তৃণমূলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস-ছাপ্পা-রিগিং-বুথ দখল নিয়ে ভূরি ভূরি অভিযোগ করেছিল বিরোধী দলগুলি। শাসক দল সে সব অভিযোগ উড়িয়ে দিলেও বিষয়টি নজর এড়ায়নি রাজ্যপালের। এ নিয়ে তিনি নির্বাচন কমিশনারের কাছে রিপোর্ট তলব করেন। ভোটের গোলমাল নিয়ে কলকাতা পুর নির্বাচনী আধিকারিক তথা দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলাশাসক শান্তনু বসু যে দু’টি রিপোর্ট কমিশনে পাঠিয়েছিলেন, তা গত ২২ এপ্রিল রাজ্যপালের কাছে জমা দেন নির্বাচন কমিশনার। কিন্তু ওই রিপোর্ট দেখে কেশরীনাথ শুধু ক্ষুব্ধ হননি, সমস্ত অভিযোগ সম্পর্কে ফের নির্দিষ্ট রিপোর্ট তলব করেন।
রাজ্যপালের কড়া মনোভাব টের পেয়ে গত ২৩ এপ্রিল কমিশনার ফের সুশান্তবাবুকে চিঠি দিয়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সমস্ত অভিযোগ সম্পর্কে নির্দিষ্ট রিপোর্ট চেয়ে পাঠান। সেই চিঠিতে কলকাতার পুরভোট নিয়ে রাজ্যপালের মনোভাবের কথাও উল্লেখ করেন কমিশনার। কমিশনকে যে ফের রাজভবনে রিপোর্ট দিতে হবে, তা-ও জানানো হয় চিঠিতে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কমিশনকে জবাবি চিঠি পাঠান পুর নির্বাচনী আধিকারিক তথা দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলাশাসক। এবং সেখানে তিনি নিজের পুরনো অবস্থানের কথাই ফের জানিয়ে দিয়েছেন। দু’একটি ক্ষেত্র বাদ দিয়ে কলকাতার পুরভোট যে অবাধ এবং শান্তিপূর্ণ হয়েছে, তা জানিয়ে তিনি লিখেছেন, সমস্ত অভিযোগ খতিয়ে দেখা হয়েছে। অধিকাংশ অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি। নির্বাচন কমিশন সূত্রের খবর, ৯১টি পুরসভার ভোট নিয়ে ব্যস্ত থাকায় শান্তনুবাবুর পাঠানো সেই জবাবি রিপোর্ট খতিয়ে দেখার সুযোগ পায়নি কমিশন।
এখন কমিশন কী করবে?
সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায় বলেন, ‘‘রাজ্যপালের নির্দেশ মতো রিপোর্ট চাওয়া হয়েছিল। সেই রিপোর্ট এসেছে। তা খতিয়ে দেখে রাজভবনে পাঠানো হবে। রাজ্যপালের পরামর্শ মতো পরবর্তী পদক্ষেপ করা হবে।’’ কিন্তু যে সব অভিযোগের কথা জানতে চেয়ে চিঠি দিয়েছিলেন কমিশনার, সে সবই তো নিজের পাঠানো রিপোর্টে অসত্য বলে জানিয়েছেন পুর নির্বাচনী আধিকারিক শান্তনু বসু! তা হলে এখন কমিশনের কী করার আছে? কমিশনার জানান, সে সব জবাব খতিয়ে দেখার কাজ চলছে। কলকাতার পুর নির্বাচনী আধিকারিক শান্তনু বসুকে বার বার যোগাযোগ করেও তাঁর বক্তব্য জানা যায়নি। তবে জেলা নির্বাচনী আধিকারিক অফিসের বক্তব্য, রিটার্নিং অফিসার এবং প্রিসাইডিং অফিসারের ডায়েরির উপর ভিত্তি করেই রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে।
পুর ভোটের দিন নির্বাচন কমিশনার বলেছিলেন, ‘‘আদর্শ পরিবেশে ভোট হলে এত অভিযোগ আসত না।’’ যদিও পরের দিনই তিনি অবস্থান বদলে বলেছিলেন, ‘‘আইডিয়াল পরিবেশ ছিল তা-ও বলছি না, ছিল না তা-ও বলছি না!’’ তাঁর এই বারবার বয়ান বদল নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল নানা মহলে। কেন এ ভাবে বারবার বয়ান বদল করেছিলেন সুশান্তবাবু?
কমিশন সূত্রের খবর, ভোটের দিন মৌখিক ভাবে গোলমালের কথা বললেও নির্বাচনী পর্যবেক্ষকদের অনেকেই তাঁদের লিখিত রিপোর্টে সে কথা বলেননি। এবং পর্যবেক্ষক ও রিটার্নিং অফিসারের রিপোর্ট অগ্রাহ্য করে স্বাধীন রিপোর্ট তৈরি করার ক্ষমতা কমিশনের নেই। সে কারণেই সুশান্ত বলেছিলেন, ‘‘সব বুথে যথাযথ পরিবেশে ভোট হয়েছে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও কোনও বুথে পুনরায় নির্বাচন হচ্ছে না।’’
এই পরিস্থিতিতে গত ২২ এপ্রিল রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে তাঁকে পুরভোটের গোলমালের বিষয়ে রিপোর্ট জমা দেন নির্বাচন কমিশনার। বিভিন্ন দল, প্রার্থী ও সাধারণ মানুষের থেকে তিনি যে সব অভিযোগ পেয়েছেন, রাজ্যপালকে তা সবিস্তার জানিয়েছিলেন কমিশনার। পাশাপাশি সুশান্তবাবুর বক্তব্য ছিল, তিনি নিজের অফিসে বসে ওয়েবক্যামে যা দেখেছিলেন, তার সঙ্গে রিটার্নিং অফিসারের রিপোর্টে ফারাক রয়েছে।
রাজভবন সূত্রের খবর, কমিশনারের দেওয়া রিপোর্ট দেখে রাজ্যপাল সন্তুষ্ট তো হননি, বরং রীতিমতো উষ্মা প্রকাশ করেন। এবং প্রতিটি অভিযোগ সম্পর্কে নির্দিষ্ট রিপোর্ট তলব করেন।
রাজ্যপালের উষ্মার ভিত্তিতে কলকাতার পুর নির্বাচনী আধিকারিক শান্তনু বসুর কাছে কী কী নির্দিষ্ট ভাবে জানতে চেয়েছিলেন কমিশনার?
কমিশনের প্রশ্ন ছিল, ৪৬ নম্বর ওয়ার্ডের ৬ নম্বর বুথ এবং ৬০ নম্বর ওয়ার্ডের ২৫ নম্বর বুথ দখল হয়ে গিয়েছে বলে ফোনে জানিয়েছিলেন সংশ্লিষ্ট প্রিসাইডিং অফিসারেরা। কিন্তু সে সম্পর্কে কোনও লিখিত রিপোর্ট মেলেনি। পাওয়া যায়নি প্রিসাইডিং অফিসারের ডায়েরি। ওই অফিসারদের শো-কজ করা হল না কেন? দ্বিতীয়ত, প্রিসাইডিং অফিসারেরা যে অভিযোগগুলি করেছিলেন, সেগুলি কি মিউনিসিপ্যাল রিটার্নিং অফিসার বা সেক্টর অফিসারের কাছে পৌঁছেছিল? এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোনও পদক্ষেপ করা হয়েছিল কি?
জবাবে পুর নির্বাচনী আধিকারিক লিখেছেন, ৬ নম্বর বরোর মিউনিসিপ্যাল রিটার্নিং অফিসার ৪৬ এবং ৬০ নম্বর ওয়ার্ডের প্রিসাইডিং অফিসারদের শো-কজ করা হয়েছে। ওই দুই বুথের প্রিসাইডিং অফিসারেরা যে অভিযোগ করেছিলেন, সেগুলি খতিয়ে দেখতে সেক্টর অফিসার এবং অ্যাসিস্ট্যান্ট মিউনিসিপ্যাল রিটার্নিং অফিসার ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা অস্বাভাবিক কিছু দেখেননি।
কমিশনের প্রশ্ন ছিল, যে সংস্থা ওয়েবক্যামগুলি দিয়েছিল, তারা জানায়, ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের তিনটি বুথে সিসিটিভি ক্যামেরার মুখ ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে কথা জেনে সেক্টর অফিসার বা মিউনিসিপ্যাল রিটার্নিং অফিসারের তরফে কেউ ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন কি? জবাবে বলা হয়েছে, ওই সংস্থা মিউনিসিপ্যাল রিটার্নিং অফিসারকে বা জেলা কন্ট্রোলে কিছু জানায়নি। তবে ভোট চলাকালীন সেক্টর অফিসার ওই তিনটি বুথে গিয়ে দেখেছিলেন, সিসিটিভি ক্যামেরা ঠিক মতো কাজ করছে।
কমিশন জানতে চেয়েছিল, পর্যবেক্ষক তাঁর রিপোর্টে জানিয়েছিলেন, ২৬ এবং ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে ঠিক মতো ভোট হচ্ছে না। এ ব্যাপারে কী পদক্ষেপ করা হয়েছে? জবাবে লেখা হয়েছে, মিউনিসিপ্যাল রিটার্নিং অফিসারকে সংশ্লিষ্ট পর্যবেক্ষক কিছু জানাননি। এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোনও তথ্য দেওয়া সম্ভব নয়।
কমিশনের প্রশ্ন ছিল, ১২২ নম্বর ওয়ার্ডের একটি বুথে ওয়েবক্যাম পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ। এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল? পুর নির্বাচনী আধিকারিক লিখেছেন, ক্যামেরা পুড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ ঠিক নয়। সেটি ঠিক মতো কাজ করেনি। সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে ঘটনাটি জানানো হলে সঙ্গে সঙ্গে বিকল্প ক্যামেরা পাঠানো হয়। ভোটগ্রহণ নির্বিঘ্নেই হয়েছে।
এ ছাড়া প্রশ্ন ছিল, ১৩২ নম্বর ওয়ার্ডের একটি বুথে ইভিএম ভেঙে দেওয়া হয়। ততক্ষণ পর্যন্ত ক’টি ভোট পড়েছিল? কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? জবাবে বলা হয়েছে, সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ ওই ঘটনা ঘটে। ততক্ষণ পর্যন্ত ৩১৯টি ভোট পড়েছিল। ইভিএম বদলানোর পরে বাকি ভোট শান্তিতেই নেওয়া হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy