সেই বাস। টেট পরীক্ষার প্রশ্নপত্র খোয়া যাওয়ার দিন পিছনের ফাইবার গ্লাসটি ছিল খোলা। (ডান দিকে) সেই জানলা শ্রীরামপুরের এক গ্যারাজে সারাই করার পর। শনিবার। — নিজস্ব চিত্র।
বাস থেকে টেট-এর প্রশ্ন উধাও হওয়া যে নেহাত দুর্ঘটনা নয়, এর পিছনে অন্য অভিসন্ধি রয়েছে, গোড়া থেকে সেই অভিযোগই করে আসছিলেন বিরোধী দলের নেতারা। শনিবার পুলিশের কাছে দায়ের করা মামলায় কার্যত সেই অভিযোগকেই মান্যতা দিল পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ। পর্ষদের প্রশাসক কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায় এ দিন বিধাননগর পূর্ব থানায় যে লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছেন, তার ভিত্তিতে পুলিশ গাফিলতি নয়, বিশ্বাসঘাতকতার মামলাই রুজু করেছে। অর্থাৎ, শনিবারই তদন্তের অভিমুখ নির্দিষ্ট করে দিল পুলিশ।
আজ, রবিবার প্রায় ২৩ লক্ষ প্রার্থীর ওই পরীক্ষায় বসার কথা ছিল। তার তিন দিন আগে গত বৃহস্পতিবার পরীক্ষাকেন্দ্রে প্রশ্নপত্র পৌঁছনোর সময় একটি প্যাকেট ‘উধাও’ হয়ে যায়। ফলে পরীক্ষা পিছিয়ে দেয় রাজ্য সরকার। কিন্তু কোথায় ওই ঘটনা ঘটেছিল, শনিবার রাত পর্যন্ত তা নিয়ে ধোঁয়াশাই থেকে গিয়েছে। যদিও প্যাকেট হারানোর পরের দিনই রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় তড়িঘড়ি সাংবাদিক বৈঠক ডেকে জানিয়েছিলেন, শ্রীরামপুর যাওয়ার পথে টেট-এর প্রশ্নপত্রের একটি প্যাকেট হারিয়ে যাওয়ায় ডাক বিভাগের বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে মধ্যশিক্ষা পর্ষদকে। পরে অবশ্য জানা যায়, দুই ডাককর্মীর সঙ্গে রাজ্য পুলিশের দুই কর্মীও পরীক্ষাকেন্দ্রে প্রশ্ন পৌঁছনোর দায়িত্বে ছিলেন। ফলে মোট চার জনের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করে পর্ষদ।
শিক্ষা দফতর জানায়, বৃহস্পতিবার সকালে প্রশ্নপত্রের ১৫৪টি প্যাকেট ডাক বিভাগের ভাড়া করা একটি বাসে চাপিয়ে সল্টেলেকে পর্ষদের অফিস থেকে হুগলি জেলায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। প্রশাসন সূত্রের খবর, পুলিশের কাছে দায়ের করা এফআইআরে পর্ষদ জানিয়েছে, নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে গোনার সময় একটি প্যাকেট কম পড়ায় সেগুলো বিলি না করে সবগুলোই সল্টলেকে মধ্যশিক্ষা পর্ষদের অফিসে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। কিন্তু ওই প্যাকেটগুলো কোথায় কোথায় পৌঁছনোর কথা ছিল, কোথায় প্যাকেট কম পড়ার বিষয়টি নজরে এল, এফআইআরে তা স্পষ্ট করেনি পর্যদ। তবে যাঁরা প্রশ্নপত্র পৌঁছনোর দায়িত্বে ছিলেন তাঁদের কর্তব্যে গাফিলতির চেয়ে পর্ষদ যে বিশ্বাসভঙ্গের উপরেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে, সেটার ইঙ্গিত তাদের লিখিত অভিযোগেই মিলেছে বলে পুলিশ সূত্রের খবর। এবং সেই অভিযোগেরই ভিত্তিতে পুলিশ অরূপ দাস ও অরূপ মুখোপাধ্যায় নামে দুই ডাককর্মী এবং চিন্ময় মণ্ডল ও হিমাদ্রিশেখর বিশ্বাস নামে রাজ্য পুলিশের দুই কর্মীর বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারা (বিশ্বাসঘাতকতা) এবং ৩৪ ধারা (একই উদ্দেশ্যে অপরাধ)-য় মামলা রুজু করেছে। তবে এখানে কেবল বিশ্বাসভঙ্গের ধারা জোড়া হলেও তদন্তে যে কার্যত ষড়যন্ত্রের বিষয়টিই খোঁজা হবে, পুলিশের একাংশের কাছে তা পরিষ্কার।
আইনজীবীদেরও একাংশের বক্তব্য, সম্মিলিত বিশ্বাসভঙ্গই ষড়যন্ত্রের জন্ম দেয়। এ ক্ষেত্রে যে-হেতু চার জনের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ আনা হয়েছে তাই বিশ্বাসভঙ্গ ছাপিয়ে ষড়যন্ত্রের বিষয়টিই তদন্তে অধিক গুরুত্ব পাবে বলে মনে করছেন ওই আইনজীবীরাও। তবে এখনও পর্যন্ত অভিযুক্ত চার জনের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করেনি প্রশাসন। এ নিয়ে শনিবার দিনভর পর্ষদের প্রশাসক কল্যাণময়বাবুর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি মোবাইলে সাড়া দেননি। মুখ খোলেননি পর্ষদের অন্য কর্তারাও।
তবে মুখ খুলেছেন যে বাসে চাপিয়ে প্রশ্ন নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, সেটির চালক স্বপন বসু ও খালাসি উজ্জ্বল কুণ্ডু। এই দু’জনকে এ দিন শ্রীরামপুর প্রধান ডাকঘরে ডেকে পাঠিয়েছিলেন ডাককর্তারা। তাঁদের প্রশ্নের জবাবে স্বপনবাবুরা দাবি করেন, শ্রীরামপুরে যাওয়ার কোনও পরিকল্পনাই ছিল না তাঁদের। ফলে পর্ষদ, এমনকী শিক্ষামন্ত্রীও কেন শ্রীরামপুরে যাওয়ার কথা বললেন তা নিয়ে ধন্দে পড়েছে পুলিশ।
ডাক সূত্রের খবর, বাসের চালক ও খালাসি ডাককর্তাদের জানান, গত বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা নাগাদ তাঁরা শ্রীরামপুর প্রধান ডাকঘরের সামনে বাস লাগান। সেখানেই বাসে ওঠেন দুই ডাককর্মী ও পুলিশের দু’জন। তাঁদের নিয়ে বাস প্রথমে সল্টলেকে পর্ষদের অফিসে আসে। সেখানেই ১৫৪টি প্যাকেট তোলা হয়।
বাসচালক ডাকঘরের অফিসারদের জানান, বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে তিনি সল্টলেক থেকে রওনা দেন। খালাসি বাসের দরজাতেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। কথা ছিল সল্টলেকের নিবেদিতা ভবন থেকে প্রশ্নপত্রের প্যাকেট তুলে ভদ্রেশ্বর, পুরশুড়া, তারকেশ্বর, সিঙ্গুর, হরিপাল হয়ে চন্দননগরে সেগুলি পৌঁছে দিতে হবে। ডাককর্তাদের কাছে স্বপনবাবুর দাবি, বিমানবন্দরের ১ নম্বর গেটের কাছে দু’টি বাস রেষারেষি করতে করতে তাঁর বাসটিকে পাশ থেকে ধাক্কা মারে। এতে ডান দিকের আয়না ভেঙে যায়। সেই অবস্থাতেই তিনি ধীরে ধীরে এগোতে থাকেন বলে ডাককর্তাদের বলেছেন স্বপনবাবু। জিজ্ঞাসাবাদের সময় তিনি আরও জানিয়েছেন, দক্ষিণেশ্বরের দিক থেকে নিবেদিতা সেতুর টোল প্লাজা পেরিয়ে বাস যখন বালির মাইতিপাড়ার কাছে পৌঁছয়, তখন পিছন থেকে একটা লরি ওভারটেক করে এসে তাঁদের জানায়, বাসের পিছনের একটি ফাইবার গ্লাস খুলে ঝুলছে। বিপদ ঘটতে পারে বুঝে সেখানেই তাঁরা বাস দাঁড় করিয়ে দেন।
ডাকঘরের অফিসারদের কাছে স্বপনবাবু ও তাঁর সহকর্মীর দাবি, বিষয়টি জানার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা বাস থেকে নেমে পড়েন ও সে কথা জানান দুই ডাককর্মী ও পুলিশকে। তাঁরাও নেমে পড়েন। স্বপনবাবু ডাককর্তাদের বলেছেন, বাস থেকে নেমে তাঁরা দেখেন যে বাসের পিছনের ফাইবার গ্লাসের একটা অংশ ঝুলছে। প্রশ্নপত্রের প্যাকেটগুলিও হেলে পড়েছে। পরিস্থিতি বেগতিক বুঝে রাস্তায় বাস দাঁড় করিয়ে তাঁরা প্যাকেট গুনতে শুরু করেন। তখনই দেখা যায়, একটি প্যাকেট কম। এর পরে শুরু হয় প্যাকেট খোঁজার পালা। কিন্তু ঘণ্টাখানেক বিস্তর খোঁজাখুঁজি করেও প্যাকেটের হদিস না পেয়ে তাঁরা গাড়ি ঘুরিয়ে নেন। বাসচালক জানান, দক্ষিণেশ্বরের কাছে এসে ডাকঘরের কর্মীরা তাঁকে বলেন, বেলঘরিয়া থানায় বাস নিয়ে যেতে। সেখানে পুলিশকে সব জানিয়ে প্যাকেট নামিয়ে ফের গোনা হয়। তাতেও দেখা যায়, একটি প্যাকেট কম। এর পরে তাঁরা সল্টলেকে পর্ষদের অফিসে ফিরে আসেন। চালক জানান, ওই দিনই রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ তাঁকে ও তাঁর সহকর্মীকে একটা সাদা কাগজে সই করিয়ে সল্টলেকের অফিস থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
প্রশ্ন এখানেই। যদি পুলিশ ও ডাককর্মীরা বাসে থাকাকালীনই প্রশ্নপত্র উধাও হয়ে গিয়ে থাকে, তবে কেন শুধু বাসের চালক ও খালাসিকে দিয়ে সাদা কাগজে সই করানো হল? এটা কি কাউকে আড়াল করতে?
প্রশ্ন আরও, বাস থেকে কী ভাবে উধাও হয়ে গেল একটি প্যাকেট? বাসকর্মীরা ডাককর্তাদের বলেছেন, পর্ষদের অফিসে যাঁরা প্রশ্নপত্রের প্যাকেট তুলছিলেন তাঁদের সেগুলো বাসে দু’আসনের মাঝে মেঝেতে সার দিয়ে রাখতে বলা হয়েছিল। কিন্তু কেন সে কথায় কর্ণপাত না করে সিটের উপরে সেগুলো ডাঁই করে রাখা হল? একেবারে পিছনের সিটে সে ভাবেই ফাইবার গ্লাসে হেলান দিয়ে রাখা হয়েছিল প্রশ্নের প্যাকেট। পুলিশ সূত্রের খবর, বাসের চালক ও খালাসিকে আজ রবিবার হাওড়ার নিশ্চিন্দা থানায় ডাকা হয়েছে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য।
প্রশ্নপত্র লোপাটের ঘটনায় বিরোধীরা প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি মানিক ভট্টাচার্যের পদত্যাগ দাবি করেছেন ইতিমধ্যেই। একই দাবিতে ডিওয়াইএফ শনিবার কলেজ স্কোয়ার থেকে মৌলালি পর্যন্ত মিছিল করে। মৌলালিতে কিছু ক্ষণ পথ অবরোধও করে তারা। তবে গোটা ঘটনায় চাপে পড়লেও পর্ষদ তাড়াহুড়ো করে এমন কিছু করতে চাইছে না, যাতে বিরোধীদের দাবির কাছে নতিস্বীকারের বার্তা যায়। আবার বাসের জানলা ভেঙে প্যাকেট পড়ে যাওয়ার তত্ত্বও পর্ষদ খুব সহজে বিশ্বাস করছে না। পুরো ঘটনায় কার কী ভূমিকা, সবটাই খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে পর্ষদ সূত্রের খবর।
শিক্ষামন্ত্রী এ দিন বলেছেন, ‘‘যাঁরা টেটে আবেদন করেছেন, তাঁরা যেন সুষ্ঠু ভাবে পরীক্ষা দিতে পারেন তার ব্যবস্থা করাই আমার প্রথম লক্ষ্য। পর্ষদ তদন্ত করে দেখুক, কেন এই ঘটনা ঘটল।’’ প্রশাসন সূত্রে অবশ্য খবর, পুলিশের পাশাপাশি শিক্ষা দফতরও তদন্ত শুরু করেছে। পার্থবাবুর কাছে জানতে চাওয়া হয়, পর্ষদ থানায় যে অভিযোগ দায়ের করেছে তা তো বিরোধীদের অভিযোগকেই সমর্থন করে? তা হলে কি এর পিছনে কোনও ষড়যন্ত্র রয়েছে? মন্ত্রী বলেন, ‘‘পর্ষদ কী অভিযোগ করেছে, তা বলতে পারব না। তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরেই বিকাশ ভট্টাচার্য (কলকাতার প্রাক্তন মেয়র, পেশায় আইনজীবী) বহু বার আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন। কিন্তু কোনও ভাবেই শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা আটকাতে পারেননি। সেটা ষড়যন্ত্র নয়তো?’’
শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য উড়িয়ে দিয়ে বিকাশবাবু বলেছেন, ‘‘আমি নিজে থেকে কোনও মামলা করিনি। যে ছাত্রছাত্রীরা আদালতে এসেছেন, তাঁদের আইনজীবী হিসেবে আমি সওয়াল করেছি। এখনও আদালতে টেট নিয়ে একাধিক মামলা চলছে।’’ তাঁর পাল্টা অভিযোগ, ‘‘প্রশ্নপত্র উধাওয়ের ঘটনা তৃণমূলের দলীয় চক্রান্ত।’’ এ দিন তমলুকে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র-ও বলেন, ‘‘টেটের প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে, সে তো অন্য কথা। এখানে প্রশ্ন বিক্রি হচ্ছে। সব চেয়ে বিপদ তাঁদের, যাঁরা পরীক্ষার জন্য তৈরি হয়েছিলেন। অনেকে ১০-২০ লক্ষ টাকা দিয়ে বসে আছেন। তাঁরা এখন ভাবছেন পরীক্ষা কবে হবে। অথচ মুখ্যমন্ত্রী এমন ভাব দেখাচ্ছেন যেন কিছুই হয়নি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy