বীরভূমের মহম্মদবাজার ব্লকে পাথর ভাঙার কারখানা। নিজস্ব চিত্র।
একটাই রং চারপাশে। ধূসর। দু’হাত দূরের মানুষের মুখও স্পষ্ট নয়। বাড়ির চাল, গাছের পাতা, দেওয়ালের গায়ে সাঁটা পোস্টার, সবেতেই পুরু ধুলোর আস্তরণ। রাস্তায় হাঁটলে ধুলোর দাপট আর কাশির দমক বহিরাগতের কাছে বাধা হয়ে ওঠে বার বার। তবু সেখানেই বসতি। পাথর ভাঙার কারখানার অদূরেই গৃহস্থের সংসার। রান্নাবান্না, শিশুদের খেলাধুলো। সেখানেই প্রতি মুহূর্তে রোগের সঙ্গে সহবাস। বীরভূমের মহম্মদবাজার ব্লকের সাগরবান্ধা গ্রামে পাথর ভাঙার কারখানার শ্রমিকেরা অবশ্য যন্ত্রের মতো বলে চলেছিলেন, ‘‘না, না, আমরা তো ঠিকই আছি।’’ তাঁদের পোশাক ধুলোয় ঢাকা। মাথার চুল, ভুরু, চোখের পাতা পর্যন্ত সাদা। কথা বলতে বলতেই খেতে বসলেন এক জন। স্টিলের থালায় ধুলো মাখা ভাত-তরকারি আলাদা করে চেনা যায় না। তবু সেটাই গলা দিয়ে নামতে থাকে অনায়াসে। সে দৃশ্য একটানা বেশি ক্ষণ সহ্য করা কঠিন।
কত বছর কাজ করছেন? এক তরুণকে সে প্রশ্ন করায় তিনি একটু ভেবে উত্তর দেন, সাত-আট বছর হবে। এত ধুলোয় অসুবিধা হয় না? উত্তর আসে, ‘‘না তো।’’ পাশ থেকে এক জন বলেন, ‘‘শরীর খারাপ হয় মাঝেমাঝে। তখন দু’দিন বাড়িতে শুয়ে থাকি। তার পর আবার আসি।’’ চোখের ইশারায় তাঁকে চুপ করিয়ে দেন অন্যেরা। আপনাদের এখানে মেডিক্যাল ক্যাম্প হয়? শেষ কবে থুতু, রক্ত পরীক্ষা হয়েছে? এক্স-রে? অবাক হয়ে মাথা নাড়েন তাঁরা। আপনাদের মাস্ক দেওয়া হয়েছে কখনও? এ বার হাসতে থাকেন সকলে। যেন খুব মজার কোনও কথা বলা হয়েছে। এক জন বলেন, ‘‘না দিদি, ও সব কখনও দেওয়া হয়নি। হবেও না। আমরা ও সব নিয়ে ভাবি না।’'
মহম্মদবাজারের চাঁদা মোড়ের কাছে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল বীরভূম জমি, জীবন, জীবিকা, প্রকৃতি বাঁচাও মহাসভার এক সদস্যের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘‘মানুষের জীবনের দাম যে কতটা কম, তা বুঝতে চাইলে এই জায়গায় আসতেই হবে। কর্মক্ষম পুরুষের সংখ্যা কমতে কমতে শূন্য হয়ে যাবে এক সময়।’’
মিনাখাঁ-য় দেখেছিলাম সন্তানহারা একাধিক পরিবার আর রোগে ভুগে তিল তিল করে শেষ হতে চলা বহু মানুষকে। আর মহম্মদবাজার সব খোয়ানো মানুষদের পাশাপাশি পরিচয় করাল না জেনেবুঝেই অনিবার্য পরিণতির দিকে এগিয়ে চলা আরও অনেকের সঙ্গে। পাথর ভাঙার কারখানা আর খাদানের ধার ঘেঁষে ঝুপড়ি ঘরগুলোতে যে সব পরিবারের বাস, সেখানে শুধু সংশ্লিষ্ট শ্রমিকরাই নন, তাঁদের পরিজনও এই বিষে একটু একটু করে শেষ হচ্ছেন। খাদান শুধু তাঁদের জমি গেলেনি, জীবনও গিলছে।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন নাগরিক মঞ্চ-র সাধারণ সম্পাদক নব দত্তের কথায়, ‘‘যাঁরা ৩৬৫ দিন এই পরিবেশে থাকছেন, কাজ করছেন, তাঁদের সিলিকোসিস না হওয়াটাই তো অস্বাভাবিক। সরকার যে রোগীদের চিহ্নিত করতে পারছে না বা চাইছে না, সেটা সরকারের ব্যর্থতা।’’
উথনাও নামে একটি সংগঠনের সম্পাদক, পরিবেশকর্মী কুণাল দেব বলেছিলেন, মহম্মদ বাজারে যত পাথর ভাঙার কল আছে তার মধ্যে মাত্র পাঁচ শতাংশ বৈধ। পাথর খাদানের ক্ষেত্রে এই বৈধের সংখ্যাটা আরও অনেক, অনেক কম। তাঁর কথায়, ‘‘এক জন মালিক, তারই হয়তো ১৫টা খাদান। একটার অনুমোদন আছে, বাকিগুলোর নেই। অথচ সবগুলোই রমরমিয়ে চলছে। দূষণ বিধি মানার কোনও বালাই নেই। পাথর ভাঙার ক'টা কলে নিয়ম মানা হয়?’’
স্থানীয় আদিবাসীরা কখনও রুখে দাঁড়াননি? তালবাঁধের এক বৃদ্ধ জানালেন, ২০১০ সাল নাগাদ জোরদার আন্দোলন দানা বেঁধেছিল। দাবি উঠেছিল, নিয়ম না মানা সমস্ত অবৈধ খাদান ও পাথর ভাঙার কারখানা বন্ধ করতে হবে। তার পর? বৃদ্ধের দীর্ঘশ্বাস ভারী হয়। ‘‘আন্দোলন যারা করছিল, তাদের দু'একজনের ভিতরেই তো ঘুণ ধরল। খাদান মালিকদের ছড়ানো টাকায় বিক্রি হল কেউ কেউ। ব্যস, লড়াই সেখানেই শেষ।’’
সরকারি স্তরে কোনও নিয়ন্ত্রণই নেই? রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্র প্রশ্ন শুনে বললেন, ‘‘নিয়ম না মানলে তো আমরা ছাড়পত্র দিই না।’’ তা হলে এ গুলো চলছে কী ভাবে? তাঁর উত্তর, ‘‘জেলা স্তরে সমস্ত ক্ষেত্রেই জেলা শাসকদের এগুলি দেখার কথা।’’ কিন্তু তা যথাযথ ভাবে দেখা হচ্ছে কি না, সেটা কে দেখবে? প্রশ্নের উত্তর ছিল না।
গড়িয়া গ্রামের মনখুশি লোহার আট বছর কাজ করেছেন পাথর ভাঙার কারখানায়। শরীর ঝাঁঝরা হতে শুরু করে। মনখুশির বরাত ভাল। এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সহায়তায় চিকিৎসা করিয়ে কারখানার কাজ ছেড়ে দিল্লি চলে আসেন। আপাতত একটি পরিবারে পরিচারিকার কাজ করেন। কিন্তু এখনও কাশির দমকে রাতে ঘুম ভাঙে। ফোনে মনখুশি বললেন, ‘‘আমার দুই ছেলেও ওই কারখানায় কাজ করত। কোনও মতে অন্য কাজ জোগাড় করে ওখান থেকে বেরোতে পেরেছে। কিন্তু গ্রামের বেশির ভাগ মানুষই তো তা পারেনি। সিলিকোসিস একের পর এক গ্রামকে গিলে খাচ্ছে।"
রাজ্য প্রশাসনের কর্তারা যদিও এখন সিলিকোসিস নিয়ে প্রশ্ন করলেই নয়া নীতির গাজর ঝোলাচ্ছেন। ‘অকুপেশনাল সেফটি অ্যান্ড হেলথ অ্যাসোসিয়েশন অব ঝাড়খণ্ড’-এর সাধারণ সম্পাদক শমিত কর জানান, ২০১৭ সালে হরিয়ানা সরকার নির্মাণকর্মীদের জন্য যে প্যাকেজ চালু করেছিল, সেটাই তাঁরা ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিলিকোসিসের ক্ষেত্রে দাবি করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের জন্য। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে এ নিয়ে কাজ করতে বলেছিল। তিনি বলেন, ‘‘এখন রাজ্য সরকার যে নীতি ঘোষণা করেছে, তাতে কিন্তু ওই হরিয়ানা মডেলের অনেক কিছুই মানা হয়নি। রোগ নির্ণয়ের কোনও চেষ্টাই হয় না। শ্রমিকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার নামে পশ্চিমবঙ্গে যা হয় সেটাও প্রহসন ছাড়া কিছু নয়।’’
নব দত্ত মনে করিয়ে দেন, ‘‘রাজ্যের মোট কর্মজীবী মানুষের মধ্যে প্রায় দু'কোটি ৯০ লক্ষ অসংগঠিত, অসুরক্ষিত। এঁদের মধ্যে কত মানুষ কোন ধরনের পেশাগত রোগের শিকার, তাঁরা কোথায়, কী অবস্থায় আছেন, সেই খবর কেউ রাখে না।’’
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy