রায়গঞ্জে মুখ্যমন্ত্রী। মঙ্গলবার তোলা নিজস্ব চিত্র।
মঙ্গলবার রায়গঞ্জের কর্ণজোড়ায় উত্তর দিনাজপুরের জেলাশাসকের দফতরের সামনে উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুরের প্রশাসনিক আধিকারিক ও পুলিশকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বেলা ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত ওই বৈঠক হয়। তারপর মুখ্যমন্ত্রী শিলিগুড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যান। ওই বৈঠকে রাজ্যের প্রতিটি দফতরের সচিবরা হাজির ছিলেন।
এ দিন ওই বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী জানান, দুই দিনাজপুরের গরিব বাসিন্দারা সরকারি পরিষেবা পাওয়া থেকে যাতে বঞ্চিত না হন, তা দেখার দায়িত্ব মুখ্যমন্ত্রীর। তিনি বলেন, জেলা পরিষদ, পঞ্চায়েত সমিতি ও পুরসভাকে এক সঙ্গে বৈঠক করে সমন্বয় রেখে উন্নয়নের কাজ চালু রাখতে হবে।
মমতার দাবি, দুই দিনাজপুরের প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনার যে সমস্ত রাস্তা পাঁচ বছরের বেশি পুরনো হয়ে গিয়েছে, সেগুলি মেরামতের কাজ শুরু হয়েছে। ২০১৪-১৫ আর্থিক বছরে উত্তর দিনাজপুরে প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা প্রকল্পে উত্তর দিনাজপুরে ৯০ কিলোমিটার নতুন রাস্তা তৈরি হয়েছে। চলতি আর্থিক বছরে আরও ১১৭ কিলোমিটার রাস্তা তৈরি করা হবে। তবে দক্ষিণ দিনাজপুরে প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা প্রকল্পে রাস্তা তৈরির কাজে অসন্তোষ প্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, গত আর্থিক বছরে দক্ষিণ দিনাজপুরে ১৪০ কিলোমিটার নতুন রাস্তা তৈরি হওয়ার কথা থাকলেও তার মধ্যে মাত্র ৬৫ কিলোমিটার রাস্তা তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘জেলাশাসক তাপসকে (তাপস চৌধুরী) বলছি, তাড়াতাড়ি লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হবে। দুই দিনাজপুরের প্রশাসনকে বলছি, প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনায় নতুন কোনও রাস্তা তৈরি বা মেরামতের যদি কোনও প্রস্তাব থাকে, তবে তা দ্রুত আমার কাছে পাঠিয়ে দিন।’’
মুখ্যমন্ত্রীর কনভয় ঘিরে ভিড় ইসলামপুরে।
২০১৪-১৫ আর্থিক বছরে দুই দিনাজপুরের ১০০ দিনের কাজের হিসেব জানার পর ক্ষোভ প্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রী দুই দিনাজপুরের বিভিন্ন বিডিওর কাছে জানতে চান, গত আর্থিক বছরে কত দিন ১০০ দিনের কাজ হয়েছে? কালিয়াগঞ্জের বিডিও জানান, ১৭.১৮ দিন, চোপড়ার বিডিও জানান ২৭ দিন, ইসলামপুরের বিডিও জানান, ৩৩ দিন, ইটাহারের বিডিও জানান, ২৭.৫ দিন, বালুরঘাটের বিডিও জানান, ১১ দিন, তপনের বিডিও জানান, ১৮ দিন, কুমারগঞ্জের বিডিও জানান ১৮.৭২ দিন ও গঙ্গারামপুরের বিডিও জানান ১৮.৭২ দিন কাজ হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী এরপর সুর চড়িয়ে বলেন, ‘‘কোনওমতেই ৪০ দিনের কম ১০০ দিনের কাজ করা যাবে না। আপনারা অন্তত ৫০ দিন কাজের ব্যবস্থা করুন। সমস্যাটা ঠিক কোথায় হচ্ছে, সেটাই তো আমি বুঝতে পারছি না।’’
দুই দিনাজপুরের প্রতিটি হাইস্কুল, প্রাথমিক স্কুল, জুনিয়ার হাইস্কুল ও শিশু শিক্ষাকেন্দ্রগুলিতে পড়ুয়ারা ঠিক মতো মিডডে মিলের খাবার পাচ্ছে কি না, সেই বিষয়ে প্রশাসনিক কর্তাদের নিয়মিত নজর রাখার নির্দেশ দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘আপনারা স্কুলে স্কুলে গিয়ে দেখুন, বাচ্চারা নিয়মিত মিড ডে মিলের খাবার পাচ্ছে কি না। একটু নড়াচড়া করুন। বাচ্চাদের খাবার খাওয়ানোটা একটা সামাজিক কাজ।’’
দুই জেলায় কতগুলি স্কুলকে মাধ্যমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিকে উন্নীত করা দরকার, সেই বিষয়ে তাঁর কাছে দ্রুত প্রস্তাব জমা দেওয়ার জন্য দুই জেলার বিদ্যালয় পরিদর্শকদের নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী। দুই জেলায় অলচিকি মাধ্যমের শিক্ষকের অভাবের কথা জেনে মুখ্যমন্ত্রী দ্রুত সমস্যার সমাধানের আশ্বাস দেন। দুই দিনাজপুরের সমস্ত স্কুলে ছাত্রীদের শৌচাগার তৈরির কাজ দ্রুত শেষ করার নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী। পাশাপাশি, ক্লিনলিনেস প্রকল্পে দুই দিনাজপুরের কোনও স্কুলে কর্মী নিয়োগ না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী। দুই জেলার জেলাশাসকেরা তাঁকে জানান, কর্মী নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে।
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘স্কুলগুলিকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে এক বছর আগে আমি দুই জেলার প্রতিটি স্কুলে ১০০ দিনের প্রকল্পে দুই জন করে কর্মী নিয়োগের নির্দেশ দিয়েছিলাম। আপনারা দ্রুত কর্মী নিয়োগের কাজ শেষ করুন।’’ উত্তর দিনাজপুর জেলায় ৭৪.৬৫ শতাংশ চাষি কিষান ক্রেডিট কার্ড পেয়েছেন বলে জানতে পেরে ক্ষোভ প্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘‘দক্ষিণ দিনাজপুরে যেখানে ৯০ শতাংশ চাষি কিষান ক্রেডিট কার্ড পেয়ে গিয়েছেন, সেখানে উত্তর দিনাজপুরে কেনও বহু চাষি কেন এখনও সেই সুযোগ পেলেন না? যা করার দ্রুত করুন! আমি এ সব বরদাস্ত করব না।’’
আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ, দুই জেলার সমস্ত থানা এলাকায় কতগুলি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, মন্দির ও ক্লাব রয়েছে, তার ডেটাবেস তৈরি করে তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখুন। দুই জেলার সীমান্ত এলাকায় আইসি-রা নিয়মিত নিজেদের মধ্যে সমন্বয় রাখুন। জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারদেরও সমন্বয় রাখতে হবে। কারণ, অনেক সময়ে দুষ্কৃতীরা সমাজবিরোধী কার্যকলাপ করে পাশ্ববর্তী জেলায় পালিয়ে যায়। তাই সীমানায় পুলিশ ও প্রশাসনকে নজর রাখতে হবে!
সভার শেষ পর্যায়ে প্রশাসন ও পুলিশকে সতর্ক করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, বিডিও ও পুলিশেরা রাস্তায় নামুন। পুলিশ রাস্তায় নামলে অপরাধ কমে। বিডিও-রা রাস্তায় থাকলে উন্নয়ন হয়। তিনি বলেন, ‘‘আপনারা রাস্তায় থেকে নিয়মিত মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে তাঁদের সমস্যার কথা জানুন। সেই মতো পদক্ষেপ করুন। মনে রাখবেন, আপনারা চেম্বারে থাকলে একজনের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন। রাস্তায় থাকলে হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে আপনারা কথা বলার সুযোগ পাবেন।’’ বৈঠকের পরে সাংবাদিক সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেন, খুব শীঘ্রই রায়গঞ্জে মাল্টি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল তৈরির কাজ শেষ করার চেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, ‘‘শুধু হাসপাতালের কাজ শেষ করলেই তো হবে না, চিকিত্সক নিয়োগ করারও বড় ব্যাপার রয়েছে।’’ তাঁর দাবি, রাজ্য সরকার দুই দিনাজপুরে ছোট শিল্প, অডিটোরিয়াম ও দক্ষিণ দিনাজপুরে একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ তৈরি করতে চায়। তিনি বলেন, ‘‘ব্যবসায়ী ও উদ্যোগপতিদের এগিয়ে আসার অনুরোধ করছি। তাঁদের বিনিয়োগ ও সহযোগিতা ছাড়া ছোট শিল্প করা সম্ভব নয়।’’ ইসলামপুর আলাদা জেলা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘কোনও কারণে দীর্ঘদিন ধরে উত্তর দিনাজপুর উন্নয়নের দিক থেকে পিছিয়ে রয়েছে! আগে জেলার উন্নয়ন করতে দিন।’’
প্রশাসনিক বৈঠকের পর এদিন মুখ্যমন্ত্রী ফলক উন্মোচন করে রাস্তা, সরকারি দফতর, পানীয় জল প্রকল্প, কৃষকবাজার, গোডাউন সহ দক্ষিণ দিনাজপুরের ২৬টি ও উত্তর দিনাজপুরের ২৯টি নানা প্রকল্পের উদ্বোধন ও শিলান্যাস করেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy