প্রতীকী ছবি।
ঘূর্ণিঝড় আর বৃষ্টি বন্ধ হওয়ার পরে চারদিন কেটে গিয়েছে। এখনও কাঁপছে গীতা মাইতির গলা। মুড়িগঙ্গা নদীর জল পেরিয়ে ভেসে এল— ‘শুধু প্রাণটাই নেয়নি। আর কিছু রাখেনি।’
দুর্যোগে জীবনটাই এলোমেলো হয়ে গিয়েছে ঘোড়ামারা দ্বীপের আশাকর্মী গীতার মতো হাজার তিন-চার মানুষের। বছর পঞ্চাশের গীতাদেবী বলছেন, ‘‘ঊনপঞ্চাশ সালের বন্যার কথা শুনেছিলাম। জীবন দিয়ে সাগরপাড়ের মানুষ বুঝেছিল, প্রকৃতি কত নির্মম। এ বার শুধু আমাদের জীবনই নেয়নি। বাকি সব নিয়ে গিয়েছে। নিঃস্ব করে দিয়েছে ঘোড়ামারার মানুষকে।’’ মন্দিরতলা পুকুরপাড়ে বাড়ি গীতাদেবীর। তিন ছেলের এক জন এখন সঙ্গে। বাকি দু’জন রয়েছেন সাগরের নিরাপদ আশ্রয়ে। বড় ছেলে আর স্বামীকে নিয়ে এখন বাঁধের উপরে গীতা।
কথা জড়িয়ে আসছিল। ১০০ কিলোমিটার দূরে কলকাতায় এসে বিঁধছিল তাঁর সব হারানোর শোক। বলছিলেন, ‘‘গোলা ভরা ধান ছিল আমাদের। আর ঝড়ের পর থেকে কোনওদিন দু’বেলা ভাত খাওয়া হয়নি।’’ বাড়ির দিকে গিয়ে একবার দেখে এসেছিলেন কী অবস্থা সেখানকার। সে কথা বলে আবেগ রাখতে পারলেন না।
ফি বছর ঘর ভাসে। জমিজিরেত, দোকানবাজার ধুয়েমুছে যায়। কিন্তু এ বারের ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাসের ধাক্কা ঘোড়ামারার মানুষকে নিয়ে গিয়ে ফেলেছে প্রায় ৭০-৭২ বছর আগের বন্যার ইতিহাসে। এখন যাঁদের জীবন লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছে তাঁদের বেশিরভাগই বাপ- ঠাকুর্দার কাছে শুনেছেন সেই সব দিনের কথা।
হাইস্কুলের পাড়ায় বাড়ি শুভ্রা দাসের। স্কুলের পার্শ্বশিক্ষক শুভ্রা বললেন, ‘‘এখন কিছুই নেই। গোটা ঘর বসে গিয়েছে মাটিতে। জল ঢুকে সব ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে।’’ পূর্ব মেদিনীপুরের মেয়ে শুভ্রার শ্বশুরবাড়ি এখন অতীত। বাবার কাছে চলে গিয়েছেন। সেখান থেকে ফোনে বললেন, ‘‘বাঁধের কোলে যাঁদের বাড়ি, তাঁদের আগে থেকে সরানো হয়েছিল। আমরা একটু উঁচু জায়গায় ছিলাম। তাই, ততটা ভয় ছিল না।’’ ঘটনার দিন সকালে একটু তাড়াতাড়িই রান্নাবান্না সেরে সবাইকে তৈরি থাকতে বলেছিলেন। বললেন, ‘‘বড় মেয়ে পূর্বাশা স্নান সেরে ঠাকুরের পুজো দিচ্ছিল। ছোট পূর্ণাশাও ঘরেই ছিল। আমি গেলাম বাঁধের দিকে নদীর জলের অবস্থা দেখতে গিয়েছিলাম।’’ তখন জল যেন আকাশ ছুঁয়ে ভেঙে পড়ছে বাঁধের গায়ে। বললেন, ‘‘মেয়ে দুটোকে উঁচু জায়গায় রেখে ছুটলাম বাড়ির দিকে। ঘর থেকে কাগজপত্র নিয়ে আসব। গিয়ে দেখলাম, জল ঢুকছে। শুধু টাকার ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে এলাম।’’ ফিরে মেয়েরা সেখানে দেখতে না পেয়ে গোটা দুনিয়া অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল শুভ্রার। পরে জেনেছিলেন, বিপদ দেখে কেউ মেয়েদের নিয়ে ত্রাণশিবিরে পৌঁছে দিয়েছেন।
ত্রাণ যে একেবারে আসেনি তা নয়। কিন্তু এখনও আটকে থাকা হাজার দেড়েক মানুষের জন্য তা সামান্যই। দু’একটি স্বেচ্ছসেবী সংস্থা ট্রলার ভা়ড়া করে খাবার পৌঁছে দিয়েছে। আর তা নিতে সারাদিন বাঁধের উপর সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছেন গীতার মতো অনেকে। পঞ্চায়েত প্রধান সঞ্জীব সাগর বলেন, ‘‘আরও ত্রাণ দরকার। দরকার বাঁধ মেরামতির কাজ। যত দ্রুত সম্ভব সে কাজ করতে হবে।’’
নিজের ঘর ভেসেছে। সঞ্চয় ভেসেছে। তবুও নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইও শুরু করেছেন দ্বীপের মানুষ। হাঠখোলার বাসিন্দা মানস কারকের বিশ্বাস, দিন ফিরবেই। তাঁর ফোনের কলার টিউন-এ বাজছে ‘এসো, এসো আমার ঘরে এসো, আমার ঘরে।’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy