অব্যাহত: দুর্ঘটনার পরে দমদম ও বেলঘরিয়া স্টেশনের মাঝের এই অংশে মোতায়েন হয়েছে আরপিএফ। তবু রেললাইন পেরিয়ে যাতায়াত চলছেই। বুধবার। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়
‘‘স্যর, গুড লিখে দাও।’’
ছোট্ট মেয়েটার এই কথাগুলোই বারবার মনে পড়ছে বরাহনগর তীর্থ ভারতী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের। তাঁরা এখনও বিশ্বাসই করতে পারছেন না, যে শিশুটি শুধু ‘রাইট’ দিলে খুশি হত না, আবদার করত ‘গুড’ লিখে দেওয়ার, সেই জুঁই ধর আর নেই। দাদুর সঙ্গে রেললাইন পেরোতে গিয়ে ট্রেনের ধাক্কায় মারা গিয়েছে সে।
বুধবার বরাহনগরের ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের ডাক্তারবাগানে জুঁইদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষক বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন, ‘‘ছোট্ট মেয়েটা আর গুড লিখে দিতে বলবে না। স্কুলের কোনও অনুষ্ঠানে আর নাচবেও না। এটা বিশ্বাস করতে সত্যিই খুব কষ্ট হচ্ছে।’’ তিনি জানান, তাঁদের স্কুলে ১৩৩ জন পড়ুয়ার মধ্যে ৪৫ জনই ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা। তারা প্রায় প্রত্যেকেই দমদম ও বেলঘরিয়া স্টেশনের মাঝের ওই রেললাইন পেরিয়ে বি টি রোডের দিকে থাকা তীর্থ ভারতী প্রাথমিক স্কুলে আসে।
ঠিক যেমন মঙ্গলবার দাদু রাজশেখর ধরের হাত ধরে লাইন পেরিয়েই স্কুলে বাংলা পরীক্ষা দিতে যাচ্ছিল আট বছরের জুঁই। সেই সময়ে লোকাল ট্রেনের ধাক্কায় দাদু ও নাতনি, দু’জনের শরীরই ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। ঘটনার পরে বুধবার সকাল থেকে ওই লাইনের ৯/১৭ এবং ৯/১৯ নম্বর স্তম্ভের মাঝের অংশ দিয়ে পারাপার আটকাতে মোতায়েন করা হয়েছে দুই আরপিএফ জওয়ানকে। কিন্তু সবাইকে যে তাঁরা আটকাতে পারছেন, তা নয়। এ দিন ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেল, লাঠি হাতে বাঁশি বাজিয়ে রেললাইন থেকে লোকজনকে সরাচ্ছেন ওই জওয়ানেরা।
বরাহনগরের বাড়িতে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন জুঁইয়ের (ইনসেটে) বাবা তারাশঙ্কর ধর। বুধবার। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়
তা সত্ত্বেও এক রকম জোর করেই লাইন পেরোচ্ছেন দুই প্রান্তের বাসিন্দারা। এ ভাবে লাইন পেরোচ্ছেন কেন? প্রশ্ন শুনেই তাঁদের পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘যেটা দশ মিনিটের পথ, সেটা অহেতুক দু’-তিন কিলোমিটার ঘুরে যাব কেন?’’ সপ্তম শ্রেণির মেয়েকে নিয়ে স্কুল থেকে ফেরার পথে রেললাইন পেরোতে গিয়ে আরপিএফের কাছে বাধা পান ডাক্তারবাগানের বাসিন্দা সঞ্জিত পাল। তাঁর কথায়, ‘‘লাইন পেরিয়ে দু’মিনিট গেলেই আমার বাড়ি। এখন প্রায় কুড়ি মিনিট সাইকেল চালিয়ে ঘুরে বাড়ি যেতে হবে।’’ তবে যাঁরা আরপিএফের বাধা না মেনেই পারাপার করছিলেন, তাঁদের ট্রেন আসা-যাওয়া সম্পর্কে সতর্ক করে দিতে দেখা গেল লাইনের ধারে বসে থাকা শ্রীপল্লির কয়েক জন যুবককে। কারণ দমদম থেকে বেলঘরিয়া পর্যন্ত ওই সোজা লাইন ধরে যে লোকাল ট্রেনগুলি চলে, তাদের গতিবেগ থাকে ঘণ্টায় ৫০ থেকে ৭০ কিলোমিটার।
দমদম স্টেশনের পর থেকে বেলঘরিয়া স্টেশনের আগে পর্যন্ত রেললাইনের ওইটুকু অংশে ‘পাহারা’ বসলেও বাকি অংশ পুরো অরক্ষিতই। মঙ্গলবারের দুর্ঘটনাস্থল থেকে কয়েক মিটার দূরেই রয়েছে সিসিআর সেতু। তার নীচ দিয়েই লাইন পেরোতে দেখা গেল আট থেকে আশির সবাইকে। যা দেখে রেললাইন সংলগ্ন একটি বাড়ির বাসিন্দা গোপাল সরকার বললেন, ‘‘এই এলাকায় লাইন পেরোতে গিয়ে কত মানুষ যে ট্রেনের ধাক্কায় মারা গিয়েছেন, তার হিসেব নেই। স্থায়ী একটা ব্যবস্থার জন্য কত আবেদন করা হয়েছে। তবু কিছু হয়নি।’’
২৪ বছর আগে এক বৃষ্টির সকালে ওই জায়গা দিয়েই লাইন পেরোতে গিয়ে ট্রেনের ধাক্কায় মারা গিয়েছিলেন গোপালের বাবা বাবলু সরকারও। আজও সেই দিনের কথা ভাবলে নিজেকে সামলাতে পারেন না গোপালের মা শেফালিদেবী। তিনি বললেন, ‘‘ছেলেরা স্কুলে যাবে বলে সবে ভাত বসিয়েছিলাম। লাইন পেরিয়ে ওপারে কাজে যাচ্ছিলেন উনি। আচমকা খবর এল, ট্রেনের ধাক্কায় সব শেষ।’’ মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টার পর থেকে তাঁদেরও সব আশা-ভরসা শেষ হয়ে গিয়েছে বলে এ দিন বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন জুঁইয়ের বাবা তারাশঙ্কর। বললেন, ‘‘আশা ছিল, ভাল করে নাচ শিখিয়ে তোকে রিয়্যালিটি শো-এ পাঠাব। তুই অনেক নাম করবি। আর তুই কি না এ ভাবে চলে গেলি মা!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy