বাঁ দিকে, শোকার্ত নারায়ণচন্দ্র মাজির পরিবার। ডান দিকে, ধান খেতে দিনভর এ ভাবেই বন দফতরের কর্মীদের সামনেই দাপিয়ে বেড়াল দাঁতাল। নিজস্ব চিত্র।
এত দিন হাতির হানার এক চেটিয়া অভিজ্ঞতা ছিল বাঁকুড়া কিংবা পশ্চিম মেদিনীপুরের শাল জঙ্গল ঘেঁষা গ্রামগুলির। এ বার তার ভয়ঙ্কর চেহারাটা দেখল মন্তেশ্বর ও ভাতার।
গলসি থেকে সাত হাতির দল চাণ্ডুল গ্রামে ঢুকে যেতেই প্রমাদ গুণেছিলেন অনেকে। এক জনকে শুঁড়ে তুলে ছুড়ে ফেলার পরে লোকালয় থেকে তাদের বের করে দেওয়ার তাড়াও বাড়ে। কিন্তু শনিবার সাত হাতির পাঁচটি বাঁকুড়ার সোনামুখীর জঙ্গলে ফিরে গেলেও এক দাঁতাল আর তার সঙ্গে একটি ছোট হাতি রয়ে যায়। রবিবার ভাতার, মন্তেশ্বর, আসাননগর, দেনুড় জুড়ে তাণ্ডব চালায় তারা। হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে মারা যান চার জন। আরও দু’জন হাসপাতালে ভর্তি। বন দফতরের দাবি, দিনভর বাসিন্দাদের দাপাদাপি, বাজির শব্দে দাঁতালটি এত ক্ষিপ্ত হয়ে যায়, যে সামলানো মুশকিল হয়ে পড়ে।
বন দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, দামোদর পেরিয়ে আসা হাতির দলটি শনিবার সকালে কুড়মুনের চন্দনপুর এলাকার আপেল মুর্মুকে নামে এক ব্যক্তিকে শুঁড় দিয়ে আছড়ে ফেলে। বুকে, মাথায় আঘাত নিয়ে তাঁকে বর্ধমান মেডিক্যালে ভর্তি করানো হয়। এ দিকে, মাঠে, খেতে ঘুরে বেড়ানো হাতি দু’টিকে নিয়ে উন্মাদনা শুরু হয়। স্থানীয় সূত্রে খবর, অনেকই অতি উৎসাহে ঢিল ছোড়েন। দেদার বাজি ফাটানো হয়। ছোট হাতিটিকে উত্যক্ত করা হয় আরও বেশি। বনকর্মীদের দাবি, তাঁরা যতক্ষণে খবর পেয়ে পৌঁছন ততক্ষণে দাঁতালটি খেপে গিয়েছে। ফলে চেষ্টা করেও সোনামুখীর দিকে ফেরানো যায়নি তাদের।
রবিবার ভোরে গলসি থেকে ভাতারের নসিগ্রামে হাজির হয় হাতি জোড়া। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ভোরে শৌচকর্ম করতে মাঠে গিয়েছিলেন বৃদ্ধা আনন্দময়ী রায়। সেখানেই তাঁকে পিষে দেয় দাঁতালটি। আনন্দময়ীদেবীর একমাত্র নাতি মঙ্গলদীপ বলে, ‘‘রোজই ভোরে বেরিয়ে আমার ঘুম ভাঙার আগে ফিরত দিদিমা। এ ভাবে বেঘোরে প্রাণ হারাবে বুঝতে পারিনি।’’ কান্নায় ভেঙে পড়েন তাঁর দুই মেয়ে শম্পা ও চন্দনাও। আনন্দময়ীদেবী যেখানে বসেছিলেন তাঁর ২০০ মিটারের মধ্যেই ছিলেন ভাতারের আর এক বাসিন্দা নারায়ণচন্দ্র মাঝি। রেহাই পাননি তিনিও। তাঁকে জমিতে তুলে আছাড় মারে হাতিটি। পরে গোঙানির আওয়াজ পেয়ে ছুটে আসেন বাড়ির লোকজন। নারায়ণবাবুর ছেলে সহদেব মাঝি বলেন, ‘‘কয়েক মিনিট বেঁচে ছিল বাবা। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সুযোগটুকুও পেলাম না।’’ হাতির এমন হামলায় অবার এলাকার বাসিন্দারাও। জয়দেব সাঁতরা, বাসুদেব রায়, স্বপন হাজরাদের দাবি, ‘‘এত দিন বাঁকুড়া, পুরুলিয়ায়, আউশগ্রামের দিকে হাতির হানার খবর পেতাম। এখানেও যে তাণ্ডব হবে বুঝিনি।’’
বেলা বাড়তে ভাতার পেরিয়ে হাতিদুটি ঢুকে পড়ে মন্তেশ্বরে। হাতির পিছনো দৌড়তে তাকে প্রচুর মানুষ। ধান খেত বাঁচাতে ও হাতি খেদাতে ফটকা ফাটানো শুরু হয়। হাতিও ছুটতে থাকে। এরপরে ঘোড়াডাঙা, ফুলগ্রাম, ইন্দ্রপুর হয়ে বাঘাসন এলাকায় পৌঁছে রুদ্র মূর্তি ধারণ করে দাঁতালটি। খেতে ধান নিড়ানোর কাজ করা প্রকাশ বাওড়াকে (৪০) পিছন থেকে শুঁড়ে পেঁচিয়ে আছড়ে মারে হাতিটি। তারপরে পা ও দাঁত দিয়ে শরীর ছিন্নভিন্ন করে দেয়। ঘটনাস্থলেই মারা যান কুসুমগ্রামের বাসিন্দা প্রকাশবাবু। সকাল দশটা নাগাদ মালডাঙা পৌঁছয় দুই হাতি। ততক্ষণে দেখা মেলে বনকর্মীদের। মশাল জ্বালিয়ে হাতি তাড়ানোর চেষ্টা শুরু হয়। মাইকে সাধারণ মানুষকে সরে যাওয়ার জন্যও বারবার আর্জি জানানো হয়। তবে কাজ হয়নি। উল্টে আরও খেপে যায় দাঁতালটি। স্থানীয়দের দাবি, প্রায় ছুটতে ছুটতে একটি মিলের কর্মী, কাটোয়ার চন্দ্রপুরের বাসিন্দা ফিরোজ শেখকে (২৬) তাড়া করে হাতিটি। তিনি জমিতে পরে গেলে পা দিয়ে পিষে দেয়।
চোখের নিমেষে দুটি মৃত্যু দেখে বন দফতরের বিরুদ্ধে ক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। ফিরোজের দেহ নিয়ে মালডাঙা এলাকায় পথ অবরোধ শুরু হয়। কুসুমগ্রামেও দুপুরে চলে অবরোধ। বাসিন্দাদের দাবি, মৃতদের পরিবারের লোকেদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। হাতিদুটিকে সরানোরও দাবি তোলেন তাঁরা। এ দিকে হাতির তাণ্ডব চলতেই থাকে। দুপুর একটা নাগাদ আসানপুর এলাকায় পৌঁছয় দুই হাতি। সেখানেও বাজি, মশাল, প্রচুর মানুষের চিৎকার চেঁচামেচি চলে। ক্ষিপ্ত হাতি তেড়ে যায় এলাকার বাসিন্দা রবি কুণ্ডু নামে এক যুবকের দিকে। স্থানীয়দের দাবি, রবির পাঁজরে দাঁত ঢুকিয়ে দেয় দাঁতালটি। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাঁকে প্রথমে মন্তেশ্বর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে পাঠানো হয়। হাতি চলে যায় দেনুরের মৌসা-সহ কয়েকটি গ্রামে।
হাতি থেকে সাধারণ মানুষকে নিরাপদ দূরত্বে রাখতে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। ঘটনাস্থলে পৌঁছন জেলা বন দফতরের আধিকারিক অজয়কুমার দাস সহ বেশ কয়েকজন। দাঁতালটিকে শান্ত করতে ঘুমপাড়ানি গুলি ছোড়ে বন দফতর। কালনার মহকুমাশাসক শুভাশিস বেইজ জানান, দাঁতালটিকে ঘুমপাড়ানি গুলি করা হয়েছে। আর খোঁজ মেলেনি। আর ছোট হাতিটিকে হুলা পার্টির লোকেরা তাড়া দিয়ে সোনামুখীর জঙ্গলের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy