গায়ের রং ঈষৎ মেটে। কানে স্পষ্ট কাটা দাগ, দাঁত তেমন বড় নয়— খুঁটিয়ে তার বিবরণ লিখে পাঠিয়েছিল বন দফতর।
বাঁকুড়ার বেলিয়াতোড় থেকে বড়জোড়া— সাড়ে পাঁচ মাসে অন্তত এগারো জন গ্রামবাসী হাতির হানায় মারা যাওয়ার পরে, বন দফতর যে হাতিটিকে ‘খুনে’ বলে চিহ্নিত করেছিল, চেহারা নাকি তার এমনই।
দিন কয়েক আগে, নিঃসঙ্গ সেই হাতিটিকে ‘রোগ’ (বিপজ্জনক) ঘোষণার পরে, ডজনখানেক গুলি ফুঁড়ে নিকেশ করে এসেছেন বন দফতরের ভাড়াটে শিকারিরা।
প্রশ্নটা উঠেছে তার পরেই— এটাই সেই খুনে দাঁতাল তো?
পাঁচাল গ্রামের শিশু বিকাশ কেন্দ্রের মহিলা কর্মীটি বলছেন, ‘‘এটা সেই খুনে হাতি হবে কেন, একে তো রোজ সাঁঝে পুকুর পাড়ে জল খেতে দেখতাম, এক্কেবারে শান্ত!’’ আর, জঙ্গল ঘেঁষা খাগ গ্রামের এক তৃণমূল নেতার কথায়, ‘‘দোষ করল এক জন, আর মরতে হল কিনা অন্যকে, এ কেমন বিচার!’’
বনকর্তারা সে কথা শুনছেন? বাঁকুড়ার ডিএফও পিনাকী মিত্র স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, যে হাতিটিকে মারা হয়েছে সেটিই ‘রোগ’। চিনতে কোনও ভুল হয়নি।
শুধু বেলিয়াতোড় নয়, নিঃসংশয় বনকর্তারা বাঁকুড়া, পুরুলিয়া এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের জঙ্গলে এমনই নিঃসঙ্গ হাতিদের একটা তালিকাও তৈরি করেছেন। ‘মেরে-ধরে’, যে করেই হোক, তাদের সবক শেখানোটাই এখন তাঁদের লক্ষ্য।
বিশিষ্ট হস্তীবিদ অর্পন শইকিয়া যা দেখে বলছেন, ‘‘দলছুট হাতি বেগড়বাই করলেই সাবাড় করে দাও। পশ্চিমবঙ্গের বনকর্তারা সংরক্ষণের বদলে এমন শিকার-প্রিয় কেন!’’
কথাটা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। বাঁকুড়ার পরে, এ বার বনকর্তাদের টার্গেট ঝাড়গ্রামের ‘চায়না’। এলাকায় খুনে বলে তার পরিচিত সেই হাতিটির খোঁজে শিকারিরা রওনা দিয়েছেন। জারি হয়েছে ফতোয়া— চায়নাকে পেলে দিন দুয়েক নজর রাখ, তবে বেগড়বাই দেখলেই ফুঁড়ে দাও গুলি!
তবে কি এটাই দস্তুর হয়ে গেল এ রাজ্যে, রাঢ়বঙ্গের শাল-পিয়ালের জঙ্গলে নিঃসঙ্গ হাতি দেখলেই নিকেশ করে দাও তাকে? প্রশ্নটা তুলছেন, দুই পড়শি রাজ্য, ঝাড়খণ্ড এবং ওড়িশার বনকর্তারা। ওড়িশার মুখ্য বনপাল এসএস শ্রীবাস্তব বলছেন, ‘‘সীমানা পেরিয়ে দলছুট হাতি পড়শি রাজ্যে যেতেই পারে। তা বলে তাকে গুলি করে দিতে হবে?’’
ঝাড়খণ্ডেও হাতির হানায় কম ভুগছেন না সেখানকার বন দফতর। সে রাজ্যের এক শীর্ষ বনকর্তা বলছেন, ‘‘দলমা থেকে প্রতি মরসুমেই দলছুট হাতি পাড়ি দিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে, তা বলে তাদের মেরে ফেলতে হবে!’’
বন-আইন অবশ্য বলছে, রোগ ঘোষণার পরেও হাতিটি স্বভাবগত ভাবেই খুনে নাকি আচমকা পরিস্থিতিগত কারনে ঘটিয়ে ফেলেছে দুর্ঘটনা— তা খতিয়ে দেখতে তাকে দিন সাতেক ধরে ট্র্যাক করার কথা। এটাই চালু রীতি। গুলি করার আগে, তার পরিচয় নিয়েও একশো ভাগ নিঃসংশয় হওয়াও আবশ্যক। বেলিয়াতোড়ে তা হয়েছিল তো?
প্রশ্নটা তুলেছেন যিনি, তিনি বন দফতরের শীর্ষ পদেই রয়েছেন। বলছেন, ‘‘দিন কয়েক আগে বিহারে নীলগাই হনন দেখে শিউরে উঠেছিলাম, এ বার হস্তী নিধন। ঘুম পাড়ানি গুলিতে হাতিটা যখন প্রায় চেতনহীন, গুলিতে তাকে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয় তখনই।’’
অথচ দেশের বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় প্রায় শীর্ষে থাকা হাতিদের এ ভাবে প্রাণে মারার কোনও কারণই দেখছেন না পশুপ্রেমীরা।
রাজ্য বন উপদেষ্টামণ্ডলীর এক সদস্য ধরিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘মনে রাখবেন, হাতিরা লোকালয়ে আসছে না ওদের ঠিকানায় আমরাই পা রাখছি।’’
পঞ্চায়েত দফতরের পরিসংখ্যান বলছে— গত পাঁচ বছরে উন্নয়নের আড়ালে, হাতের তেলোর মতো বলিরেখা দীর্ণ হয়ে উঠেছে জঙ্গল। দক্ষিণবঙ্গে বনের সরু মেঠো রাস্তায় সুরকি ফেলে একের পর এক গড়ে উঠেছে ‘অরণ্য সরণী’। যার কোপে জঙ্গলের নিশ্ছিদ্র আবহটাই নষ্ট হতে বসেছে। গত পাঁচ বছরে দক্ষিণবঙ্গের এই তিন জেলায় এমনই ৫৮৯ কিলোমিটার অরণ্য সরণী হয়েছে, কখনও জেলা পরিষদের উদ্যোগে, কখনও বা একশো দিনের কাজের টাকায়। বাঁকুড়ার এক শীর্ষ বনকর্তা বলছেন, ‘‘বছর কয়েক আগেও, এ বন থেকে অন্য বনে পাড়ি দিতে, হাতিদের একটা বড় রাস্তা পার হলেই চলত।’’ অরণ্য পথের ঠেলায় এখন তাদের দু’তিন কিলোমিটার হাঁটলেই পেরোতে হচ্ছে ব্যাস্ত অরণ্য সরণী। গ্রামবাসীদের মুখোমুখি পড়ে দুর্ঘটনাও ঘটছে অহরহ।
দিন কয়েক আগে, সে আশঙ্কা প্রকাশ করেই ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। এক বনকর্তা বলছেন, ‘‘আর তাতেই কাল হয়েছে, রাজা যত বলে, পারিষদ দলে, বলে তার শতগুণ!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy